পুলিশ কন্সটেবলের ছেলে থেকে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিমের গল্প

আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিম
ছবিঃ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিম

মুম্বাই পুলিশে কর্মরত ছিলেন ইব্রাহিম কাস্কর। ডোঙ্গরি-নাগপাডা এলাকায় তার কর্তব্যপরায়ণতা ও সততা সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। কিন্তু তার ১২ সন্তানের অন্যতম দাউদ ইব্রাহিম তার পিতার পেশা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর দাউদের অপরাধ জগতে প্রবেশ শুরু হয়।

প্রথমদিকে ছোটখাটো চুরি ও পকেটমারি দিয়ে শুরু হয় দাউদের অপরাধজীবন। এরপর বন্ধুদের নিয়ে মারপিট, দল গঠন এবং স্থানীয় গ্যাংদের সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে তিনি তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে শুরু করেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে দাউদ সেই সময়ের প্রতাপশালী পাঠান গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। এভাবেই ভারতীয় অপরাধ জগতের ইতিহাসে তার নাম উঠে আসে।

দাউদের উত্থান এবং ডি কোম্পানির জন্ম

দাউদ ইব্রাহিম তার ভাই সাব্বিরসহ একটি শক্তিশালী গ্যাং তৈরি করেন, যা পরে সংবাদমাধ্যমে ‘ডি কোম্পানি’ নামে পরিচিত হয়। তাদের প্রথম বড় অপরাধ ছিল একটি ব্যাংক ডাকাতি। মুম্বাইয়ের কার্ণাক বন্দর এলাকার মেট্রোপলিটন কোঅপারেটিভ ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা লুট করা হয়।

দাউদের অপরাধমূলক কার্যক্রমের কারণে তার পিতা ইব্রাহিম কাস্কর চরম হতাশ হন। ছেলের অপরাধ শুনে তিনি নিজ হাতে দাউদ ও তার ভাই সাব্বিরকে বেল্ট দিয়ে মারধর করেন এবং পরে পুলিশ দপ্তরে নিয়ে গিয়ে তাদের কার্যকলাপের জন্য ক্ষমা চান। তার এই সততা অফিসারদের সহানুভূতিশীল করলেও দাউদের অপরাধ থামানো যায়নি।

প্রতিশোধের গল্প এবং গ্যাংয়ের লড়াই

মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতে প্রবেশ করার পর থেকেই দাউদ বিভিন্ন গ্যাংয়ের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। পাঠান গ্যাংয়ের সদস্যরা তার ভাই সাব্বিরকে হত্যা করলে দাউদ প্রতিশোধ নিতে কারিল লালার ভাইপো সামাদ খানকে হত্যা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের পর দাউদ মুম্বাই ছেড়ে দুবাইয়ে চলে যান এবং সেখান থেকে তার গ্যাং ‘ডি কোম্পানি’র কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

১৯৯৩ সালের সিরিয়াল বিস্ফোরণ

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর মুম্বাইয়ে শুরু হওয়া দাঙ্গায় মুসলমানদের হত্যাকাণ্ড দাউদকে বিচলিত করেছিল। দাঙ্গার পরে কয়েকজন মুসলিম নারী তাকে চুড়ি পাঠিয়ে অপমান করেন। এরপর তিনি ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ মুম্বাইতে সিরিয়াল বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই বিস্ফোরণে ২৫৭ জন নিহত এবং ৭০০ জন আহত হন। দাউদকে এই ঘটনার মূল চক্রী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।

আরও পড়ুন- লাশ কাটাকে কেন ময়নাতদন্ত বলা হয়?

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগসূত্র

দাউদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে আল কায়েদা এবং লস্কর-এ-তৈয়েবার মতো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাকে ‘গ্লোবাল টেররিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং তার সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গেও দাউদের যোগসূত্র থাকার অভিযোগ উঠে।

পাকিস্তানে আশ্রয়

দাউদ ইব্রাহিম বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থান করছেন বলে মনে করা হয়। ভারত বারবার অভিযোগ করে এসেছে যে, পাকিস্তানের আইএসআই তাকে সমর্থন দিচ্ছে। যদিও পাকিস্তান সরকার দীর্ঘদিন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে, ২০২০ সালে পাকিস্তানের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় দাউদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা প্রমাণ করে যে তিনি পাকিস্তানেই অবস্থান করছেন।

দাউদ ইব্রাহিমের জীবন ও কর্মকাণ্ড ভারত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত ও বিতর্কিত। তার অপরাধজগতে প্রবেশ, উত্থান এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংযোগ তাকে অপরাধ জগতের এক অনন্য চরিত্রে পরিণত করেছে। তার পিতার সততা এবং দাউদের অপরাধজীবনের বৈপরীত্য সমাজে একটি শিক্ষণীয় বার্তা প্রদান করে—সৎ পথে চলার মূল্য কখনো কম নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *