
বাংলাদেশ ক্রিকেটে পেস বোলিং বিভাগে এক নতুন যুগের সূচনা হলো। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গতিদানব পেসার শন টেইটকে নতুন পেস বোলিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। গতকাল রোববার (১২ মে) এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই ঘোষণা দিয়েছে বিসিবি। ৪২ বছর বয়সী এই অভিজ্ঞ কোচ ২০২৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিসিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। চলতি মাসের শেষ ভাগে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কাজ শুরু করবেন।
পেছনে ফেলে গেলেন এডামস, এলেন টেইট
বিসিবির এই ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই সাবেক পেস বোলিং কোচ আন্দ্রে এডামসের পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে বোর্ড। নিউজিল্যান্ডের সাবেক পেসার এডামস ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এক বছরের কম সময়ে দলের তিন ফরম্যাটেই পেস বোলিং ইউনিটের মানোন্নয়নে কাজ করেন।
বিসিবির বিবৃতিতে বলা হয়, “চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই বোর্ড এবং কোচ এডামস পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশের পেস ইউনিটে তার অবদানের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ এবং তার আগামীর পথচলায় সফলতা কামনা করি।”
টেইটের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপট দেখানো টেইট এখন কোচিং ক্যারিয়ারে নিয়মিত মুখ। এর আগে পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দল এবং আফগানিস্তান জাতীয় দলের বোলিং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, বিপিএল, পিএসএল, বিবিএল, এলপিএল এবং ইংলিশ কাউন্টির মতো জনপ্রিয় লিগগুলোতেও কোচ হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও রয়েছে তার পরিচিতি। চিটাগাং কিংসের হয়ে ২০১২-১৩ মৌসুমে খেলেছেন তিনি এবং সর্বশেষ বিপিএলে ছিলেন দলের প্রধান কোচ। এ ছাড়া ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের অংশ ছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারে ৫৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এই ডানহাতি পেসারকে ইতিহাসের অন্যতম দ্রুততম বোলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশের তরুণ পেসারদের নিয়ে আশাবাদী টেইট
বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়া প্রসঙ্গে টেইট বলেন, “বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে কাজ শুরু করার জন্য সময়টা একেবারে উপযুক্ত। এটি সম্ভবত একটি নতুন যুগের সূচনা। বাংলাদেশ দলের তরুণ পেসারদের নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক ইতিবাচক আলোচনা চলছে, যা আমার জন্য অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাশা অনেক বেশি। এখানে প্রতিভা থাকলেই চলবে না, ফল আনাও জরুরি। আমি বাংলাদেশের পেস গ্রুপকে নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করব, যাতে তারা ধারাবাহিকভাবে দলের জয় এনে দিতে পারে। পাশাপাশি ফিল সিমন্সের মতো অভিজ্ঞ কোচের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা হবে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমি তৈরি।”
আরও পড়ুন : ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা পাকিস্তান সফর নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫
ফিল সিমন্সের অধীনে নতুন কৌশলগত সমন্বয়
উল্লেখ্য, টেইট বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ ফিল সিমন্সের অধীনে কাজ করবেন। এ বছরের শুরুতেই সিমন্স বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন। এবার টেইটকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বোঝাতে চাচ্ছে, তারা পেস বোলিং বিভাগে একটি সুসংগঠিত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের তরুণ পেসাররা যেমন: শরিফুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ, তানজিম সাকিব, এবাদত হোসেন কিংবা খালেদ আহমেদের পারফরম্যান্সে বোর্ড আশাবাদী। টেইটের অধীনে এই প্রতিভাবান পেসাররা আরও শাণিত হবে, এমনটাই প্রত্যাশা ক্রিকেটপ্রেমীদের।
কোচ টেইটের নিয়োগে নতুন আশার আলো
টেইটের মতো অভিজ্ঞ এবং সাহসী চরিত্রের আগমনে বাংলাদেশের পেস বোলিং ইউনিটে এক নতুন মাত্রা যোগ হবে বলেই বিশ্বাস করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, টেইট শুধুমাত্র গতির প্রতীক নন, বরং নিজের ক্যারিয়ারে বারবার চোট ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যেভাবে প্রত্যাবর্তন করেছেন, তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের তরুণ পেসারদের মানসিক দৃঢ়তাও বাড়াবে।
এছাড়াও টেইটের নিয়োগ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিসিবি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী পেস নির্ভর ক্রিকেট গড়তে। উপমহাদেশে স্পিন নির্ভর ক্রিকেটের যুগ পেছনে ফেলে বাংলাদেশ যখন বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চায়, তখন টেইটের মতো গতিময় চিন্তাধারার কোচ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
সারসংক্ষেপ: শন টেইটের নিয়োগ সম্পর্কিত মূল তথ্য
বিষয় | তথ্য |
নতুন দায়িত্ব | বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ |
কোচের নাম | শন টেইট |
জাতীয়তা | অস্ট্রেলিয়ান |
বয়স | ৪২ বছর |
চুক্তির মেয়াদ | মে ২০২৫ – নভেম্বর ২০২৭ |
পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা | পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ (টেস্ট), বিপিএল, পিএসএল, বিবিএল, এলপিএল, ইংলিশ কাউন্টি |
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার | ৫৯টি ম্যাচ (সব ফরম্যাট মিলিয়ে) |
বিখ্যাত পরিচিতি | ইতিহাসের অন্যতম দ্রুততম বোলার |
বিসিবির পূর্ববর্তী কোচ | আন্দ্রে এডামস (পদত্যাগ) |
বিসিবির মন্তব্য | পারস্পরিক সমঝোতায় এডামসের বিদায়, অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা |
বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য এটি নিঃসন্দেহে এক সাহসী পদক্ষেপ। এখন দেখার পালা, শন টেইটের গতির মন্ত্রে বাংলাদেশের পেসাররা কতটা ধারালো হয়ে উঠতে পারেন। তবে ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রত্যাশা, নতুন কোচের অধীনে পেস আক্রমণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি—সব ফরম্যাটেই বাংলাদেশ নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারবে।
টেইটের নিয়োগ নিয়ে ক্রিকেটাঙ্গনে প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ ক্রিকেটে শন টেইটের আগমনকে অনেক সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক স্বাগত জানিয়েছেন। টাইগারদের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা বলেন, “টেইটের মতো একজন স্পিডস্টারের অভিজ্ঞতা তরুণদের অনুপ্রাণিত করবে। আমাদের ছেলেদের গতি আছে, কিন্তু একে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত দিকনির্দেশনা।”
ক্রিকেট বিশ্লেষক আতহার আলী খান বলেন, “বাংলাদেশ এখন পেসার তৈরি করতে চায়, যাদের দিয়ে বিদেশের কন্ডিশনেও ম্যাচ জেতানো যাবে। শন টেইটকে আনাটা সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।”
বাংলাদেশ ক্রিকেটের পেস বোলিং – অতীত থেকে বর্তমান
একসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটে পেসারদের ভূমিকা ছিল নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। মাশরাফি, রুবেল, শাহাদাতদের পরবর্তী প্রজন্মে মুস্তাফিজুর রহমানের কাটার জাদু কিছুটা গতি আনলেও, সামগ্রিক পেস আক্রমণ কখনোই ধারাবাহিক ছিল না। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলাম, এবাদত হোসেনদের পারফরম্যান্স বোর্ডকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে।
বিশেষ করে এবাদত হোসেনের ভারতের বিরুদ্ধে টেস্টে ম্যাচজয়ী বোলিং কিংবা তাসকিনের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পারফরম্যান্স বোর্ডকে পেস নির্ভর আক্রমণের সম্ভাবনা দেখিয়েছে।
ফিল সিমন্স ও শন টেইট: যুগলবন্দিতে নতুন পরিকল্পনা
২০২৫ সালের শুরুতে ফিল সিমন্সকে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে বিসিবি ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারা আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোচিং স্টাফ গড়ে তুলতে চায়। সিমন্স নিজেও একজন অভিজ্ঞ ব্যাটিং এবং দলগঠন কৌশলবিদ হিসেবে সুপরিচিত। তার অধীনে টেইটের নিয়োগ বোঝায়, বাংলাদেশ কেবল স্কিল ট্রেনিং নয়, বরং কৌশলগত দিকেও উন্নয়ন চায়।
দু’জনের কাজের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এক—একটি প্রতিযোগিতামূলক, গতিময়, এবং আক্রমণাত্মক বাংলাদেশ দল গঠন।