
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবারও বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত হলেন। জাপানের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সোকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সামাজিক উদ্ভাবন, মানবকল্যাণ ও বৈশ্বিক উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি (Honorary Doctorate) প্রদান করেছে।
টোকিওতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল ক্যাম্পাসে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে আজ শুক্রবার (৩০ মে) এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জাপানের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সুধীজনেরা।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ড. ইউনূসের প্রভাব
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মূলত ‘ক্ষুদ্রঋণ’ ধারণার জনক হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। অর্থনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী এই বাঙালি মনীষী প্রথমবারের মতো বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর উদ্ভাবিত Microcredit Model এখনো পৃথিবীর শতাধিক দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে অনুসৃত হচ্ছে।
২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। এটি ছিল শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং উন্নয়ন অর্থনীতির ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক।
সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “অধ্যাপক ইউনূস তাঁর জীবনব্যাপী মানবকল্যাণে যেভাবে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন এবং নতুন নতুন সামাজিক ধারণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে চিন্তা করার নতুন দিগন্ত উপহার দিয়েছেন, তা সত্যিই অসাধারণ। এই সম্মাননার মাধ্যমে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর সেই অবদানের স্বীকৃতি জানাচ্ছি।”
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রেসিডেন্ট ও সিনেট সদস্যদের মতে, “ড. ইউনূসের আদর্শ ও চিন্তাধারা শিক্ষার্থীদের জন্য অনন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। একজন ব্যক্তিও যদি একটি নতুন সমাজিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারেন—এ বিশ্বাস আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রে রাখতে চাই।”
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য
সম্মাননা গ্রহণের পর এক অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতায় ড. ইউনূস বলেন,
“এই ডিগ্রি শুধু আমার জন্য নয়, এটি তাদের জন্য যারা নিজের জীবন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে এবং সমাজের পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। আমার বিশ্বাস, তরুণ প্রজন্ম যদি ইতিবাচক চিন্তা আর সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসে, তবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য একদিন ইতিহাসে ঠাঁই পাবে।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা এমন এক পৃথিবী গড়তে চাই যেখানে দারিদ্র্য হবে জাদুঘরের বস্তু, তরুণেরা হবে উদ্যোক্তা, এবং ব্যবসা হবে সমাজের জন্য কল্যাণময়।”
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ রাজনীতিবিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা
সোকা বিশ্ববিদ্যালয়: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
সোকা ইউনিভার্সিটি (Soka University) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালে। এটি জাপানের উচ্চশিক্ষার জগতে একটি অগ্রণী ও বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, শান্তি এবং সামাজিক ন্যায়ের ধারণা ছড়িয়ে দেওয়াই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করেছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
- নেলসন ম্যান্ডেলা
- মিখাইল গর্বাচেভ
- রিগোবার্তা মেনচু
- মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের উত্তরসূরিরা
এই তালিকায় এবার যুক্ত হলেন ড. ইউনূস, যা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এক গর্বের বিষয়।
এর আগে সম্মাননা প্রাপ্তির ইতিহাস
ড. ইউনূস এর আগেও বিশ্বের নানা প্রান্তের ৬০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি
- অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি
- লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস
- মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি
- কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি
- দিল্লি ইউনিভার্সিটি
- সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা তাই তাঁর দীর্ঘ পথচলার আরও একটি মূল্যবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সামাজিক ব্যবসার নতুন দিগন্ত
ড. ইউনূস শুধু ক্ষুদ্রঋণেই থেমে থাকেননি। তিনি ‘সোশ্যাল বিজনেস’ বা ‘সামাজিক ব্যবসা’ ধারণা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার পরিবর্তে সমাজকল্যাণভিত্তিক ব্যবসা কীভাবে দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে—সে দিকনির্দেশনা দিয়ে তিনি নতুন অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উদ্ভাবক হয়ে উঠেছেন।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ইউনূসের ‘সোশ্যাল বিজনেস মডেল’ অনুসরণে নীতিমালা গ্রহণ করছে। জাতিসংঘসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁকে উন্নয়ন ভাবনার অন্যতম পরামর্শদাতা হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকে।
কেন এই সম্মান বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বপরিসরে যখন নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়া, তখন ড. ইউনূসের এ ধরনের সম্মাননা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। এটি শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং দেশের মানবসম্পদ, সামাজিক উদ্ভাবন ও দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের উদাহরণকে সামনে এনে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে,
“একটি দেশের নাগরিক যখন এমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন, তখন তা গোটা জাতিকে সম্মানিত করে।”
সারাংশ (সংক্ষিপ্ত রিভিউ)
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
প্রধান ব্যক্তি | অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস |
সম্মাননা | সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি |
প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান | সোকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান |
তারিখ | ৩০ মে ২০২৫ |
স্থান | টোকিও, জাপান |
সম্মাননার কারণ | সামাজিক উদ্ভাবন, মানবকল্যাণ, বৈশ্বিক উন্নয়ন |
অতীত সম্মাননা | ৬০+ আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় |
বিশেষ বক্তৃতার মূল বক্তব্য | তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়া ও দারিদ্র্য নির্মূলের প্রতিশ্রুতি |
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই সম্মাননা কেবল একজন ব্যক্তির প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রদ্ধা প্রকাশ নয়, বরং এটি নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করার এক যুগান্তকারী বার্তা। সমাজ পরিবর্তনের যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন, তার বাস্তব প্রতিফলনই আজকের এই সম্মান। এ সম্মান বাংলাদেশের গর্ব, ভবিষ্যতের দিশা, এবং মানবকল্যাণে নিরলস সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।