চীনের ‘ডিপসিক’-এর আর-১ মডেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে

চীনের ‘ডিপসিক’-এর আর-১ মডেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে
চীনের ‘ডিপসিক’-এর আর-১ মডেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে নতুন চমক হয়ে এসেছে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিপসিক (DeepSeek)। তাদের তৈরি নতুন এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট ‘আর-১’ (R-1) ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এটি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে গুগলের ‘Gemini’, ওপেনএআইয়ের ‘ChatGPT’ ও অ্যানথ্রপিকের ‘Claude’-এর মতো খ্যাতিমান এআই মডেলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আর-১ কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিক থেকেই নয়, বরং খরচের দিক থেকেও এক নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে, যা বৈশ্বিক এআই প্রতিযোগিতায় চীনের অবস্থানকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।

অ্যাপ স্টোরে অভাবনীয় সাড়া

চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ‘আর-১’ আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকেই এটি রীতিমতো ঝড় তোলে প্রযুক্তি দুনিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি খুব দ্রুত সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফ্রি অ্যাপের তালিকায় উঠে আসে। এমন অভাবনীয় সাড়া প্রযুক্তি বাজারে চীনা কোম্পানিগুলোর আধিপত্যের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এমন আকস্মিক জনপ্রিয়তা পশ্চিমা প্রযুক্তি জায়ান্টদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। এটি প্রমাণ করে, এআই খাতে চীন আর কেবল অনুসরণকারী নয়, বরং প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছে।

সাশ্রয়ী খরচেই উচ্চমানের এআই

ডিপসিকের সবচেয়ে আলোচিত দিকটি হলো, তারা মাত্র ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে তাদের ‘আর-১’ মডেলটি তৈরি করেছে। এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পরই গুঞ্জন শুরু হয়: কীভাবে এত কম খরচে একটি কার্যকর, শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় এআই তৈরি সম্ভব?

তুলনামূলকভাবে, ওপেনএআই, গুগল বা মেটার মতো কোম্পানিগুলো তাদের ভাষা মডেল তৈরিতে ব্যয় করেছে শত শত মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ডিপসিকের এই সাশ্রয়ী ও দক্ষ উৎপাদন প্রক্রিয়া এআই শিল্পের প্রচলিত ব্যয় কাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

এই মডেল তৈরি করতে ডিপসিক ব্যবহার করেছে মার্কিন কোম্পানি NVIDIA-র প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি জিপিইউ চিপ, তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—তারা মূলত কম খরচের ও সহজলভ্য চিপসেট ব্যবহার করেই মডেলটিকে সফল করেছে।

প্রযুক্তি উদ্যোক্তা লিয়াং ওয়েনফেং-এর দূরদর্শিতা

ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং নিজেই একজন খ্যাতিমান প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। তার নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠানটি এত অল্প খরচে শক্তিশালী এআই তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে। তার মতে, উন্নতমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে সর্বদা বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না; সঠিক কৌশল, হার্ডওয়্যার ও এলগরিদম থাকলেই সীমিত বাজেটেও বিশাল সাফল্য অর্জন সম্ভব।

বিশ্লেষকরা বলছেন, লিয়াংয়ের এই দর্শন আগামী দিনে এআই শিল্পের ব্যবসায়িক মডেল ও গবেষণা নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।

NVIDIA-র বড় ক্ষতি

ডিপসিকের এই সাশ্রয়ী ও কার্যকর এআই তৈরির কৌশলের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে মার্কিন চিপ নির্মাতা NVIDIA-র ওপর। ২০২৫ সালের ২৭ জানুয়ারি, একদিনেই NVIDIA-র বাজার মূল্য প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার কমে যায়—যা প্রযুক্তি দুনিয়ায় এক বড় ধাক্কা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ডিপসিকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমূল্যে কার্যকর এআই মডেল তৈরি করতে পারে, তাহলে NVIDIA-এর মতো উচ্চমূল্যের চিপ সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর চাহিদা কমে যেতে পারে। একইসঙ্গে, গুগল, ওপেনএআই, মেটা কিংবা মাইক্রোসফটের মতো বড় এআই কোম্পানিগুলোও খরচ-সাশ্রয়ী প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।

চ্যাটজিপিটি-স্টাইলের সুবিধা, কিছু সীমাবদ্ধতা

ডিপসিকের ‘আর-১’ একটি ভাষাভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহকারী, যা মূলত ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটির মতো কাজ করে। এটি দিয়ে ব্যবহারকারীরা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিশ্লেষণ জানতে পারেন, লেখার মান উন্নত করতে পারেন বা দৈনন্দিন কাজে সহায়তা পেতে পারেন।

তবে, রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল প্রশ্নে ‘আর-১’ এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, বিবিসির এক সাংবাদিক যখন ১৯৮৯ সালের তিয়ানানমেন স্কয়ারের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন ‘আর-১’ কোনো উত্তর দেয়নি। এটি চীনের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিয়ে প্রোগ্রাম করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আরও পড়ুনঃ হোয়াটসঅ্যাপের কল মার্জ ফিচারে সাইবার প্রতারণা

বিশ্ব এআই বাজারে চীনের নতুন অবস্থান

ডিপসিকের উত্থান কেবল একটি কোম্পানির সাফল্য নয়, বরং এটি চীনের প্রযুক্তি কৌশলের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। এআই খাত দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা প্রযুক্তি জায়ান্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, চীনের এই অগ্রগতি বিশ্ব বাজারে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, “চীন আর এআই প্রযুক্তির অনুকরণকারী নয়, বরং উদ্ভাবনের কেন্দ্র হয়ে উঠছে। ডিপসিক সেই পরিবর্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি।”

সামনে কী?

বিশ্বের বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখন এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে: তারা কি ডিপসিকের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে? নাকি আগামী দিনে বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে চীনের আধিপত্য আরও জোরালো হবে?

একইসঙ্গে এটি প্রমাণ করে দিচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর কেবল প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার বিষয় নয়—এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক শক্তির লড়াইয়েও পরিণত হচ্ছে।

ডিপসিকের ‘আর-১’ মডেল বিশ্ব এআই দুনিয়ায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি শুধু খরচে সাশ্রয়ী বা প্রযুক্তিতে উন্নত নয়—বরং এটি এআই নিয়ে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার গতিপথকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে।

এই অগ্রগতির মাধ্যমে চীন প্রমাণ করতে চাচ্ছে—তারা শুধু অনুসরণকারী নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রযুক্তি যুদ্ধে একজন ‘গেম চেঞ্জার’। এখন দেখার বিষয়, এই চ্যালেঞ্জের মুখে পশ্চিমা প্রযুক্তি জগত কীভাবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে।


চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিপসিক (DeepSeek) তাদের নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল ‘আর-১’ (R-1) উন্মোচনের মাধ্যমে বিশ্ব এআই খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারে তৈরি এই ওপেন সোর্স মডেলটি ইতিমধ্যে ওপেনএআই, গুগল ও মেটার মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে citeturn0search1।

আর-১: কম খরচে উচ্চমানের এআই

ডিপসিকের আর-১ মডেলটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ২ হাজার এনভিডিয়া চিপ, যেখানে ওপেনএআই বা গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মডেল তৈরিতে হাজার হাজার চিপ ব্যবহার করে থাকে citeturn0search2। এই কম খরচে উন্নত এআই মডেল তৈরি করে ডিপসিক প্রমাণ করেছে যে, সীমিত সম্পদ ব্যবহার করেও উচ্চমানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব।

ওপেন সোর্সের মাধ্যমে সবার জন্য সহজলভ্য

ডিপসিকের আর-১ মডেলটি সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স, যা ব্যবহারকারীদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী মডেলটি কাস্টমাইজ করার সুযোগ দেয় citeturn0search0। এটি ছোট ও মাঝারি আকারের ডেভেলপারদের জন্য একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যারা এখন কম খরচে উন্নত এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছেন।

বিশ্ব এআই বাজারে চীনের নতুন অবস্থান

ডিপসিকের এই সাফল্য চীনের এআই খাতে অগ্রগতির একটি বড় উদাহরণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন এখন আর কেবল এআই প্রযুক্তির অনুসারী নয়, বরং উদ্ভাবনের পথিকৃৎ হয়ে উঠছে। ডিপসিকের আর-১ মডেল বিশ্ব এআই দুনিয়ায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা ভবিষ্যতে প্রযুক্তি খাতে চীনের নেতৃত্বকে আরও সুদৃঢ় করতে পারে।

One thought on “চীনের ‘ডিপসিক’-এর আর-১ মডেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *