
বর্তমান যুগে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলো। বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং হোক কিংবা অফিসের জরুরি মিটিং—সবকিছুই এখন হচ্ছে মোবাইল ফোনেই। বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যা্পের জনপ্রিয়তা যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তবে প্রযুক্তির এই আশীর্বাদই কখন যে অভিশাপে পরিণত হয়, তা অনেকেই বুঝে ওঠার আগেই বিপদে পড়েন। সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপের কল মার্জ ফিচার ব্যবহার করে সাইবার প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, যা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
কী এই ‘কল মার্জ’ ফিচার?
হোয়াটসঅ্যাপ কল মার্জ একটি কার্যকর এবং উপযোগী ফিচার, যার মাধ্যমে একাধিক কলারকে এক কলেই যুক্ত করা যায়। অফিস মিটিং, গ্রুপ ডিসকাশন কিংবা বন্ধুবান্ধবের আড্ডা—সবখানেই এই ফিচারটির ব্যবহার বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। তবে সুবিধার এই ফিচারটি এখন হ্যাকারদের নতুন অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কীভাবে ফিচারটি ব্যবহার করে প্রতারণা করছে হ্যাকাররা?
সাইবার অপরাধীরা আগে থেকেই ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত ও ব্যাংক সম্পর্কিত কিছু তথ্য সংগ্রহ করে রাখে। এরপর তারা নির্দিষ্ট কৌশলে ফোন করে জানায়, একজন পরিচিত ব্যক্তি জরুরি প্রয়োজনে কল মার্জ করতে চাচ্ছেন। হয়তো বলা হয়, “আপনার বন্ধু রাহুল আপনাকে একটি জরুরি গ্রুপ কলে যুক্ত করতে চাইছেন।” আপনি যদি না বুঝে কল মার্জ করেন, তাহলে সেই কলের মধ্যে এক বা একাধিক অপরিচিত হ্যাকারও যুক্ত থাকে।
কল মার্জ করার পর, যদি আপনার ফোনে কোনও ব্যাংক থেকে ওটিপি (OTP) আসে, হ্যাকার সেই নম্বর শুনতে পারে। কারণ আপনি যাদের সঙ্গে কল মার্জ করেছেন, তারা আপনার কথোপকথন শুনতে সক্ষম। ওটিপি পেয়ে গেলে তারা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে মুহূর্তের মধ্যেই অর্থ সরিয়ে ফেলতে পারে।
প্রতারণার পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটে?
এই প্রতারণার পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্তর:
তথ্য সংগ্রহ: হ্যাকাররা আগে থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে আপনার কিছু ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য সংগ্রহ করে রাখে, যেমন—মোবাইল নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ইমেইল ইত্যাদি।
বিশ্বাস অর্জন: অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে তারা পরিচিত কারও নাম নেয়, যাতে আপনি সন্দেহ না করেন।
কল মার্জ অনুরোধ: বলা হয় যে জরুরি কোনো আলোচনায় আপনাকে যুক্ত করতে চায় আপনার বন্ধু বা ব্যাংক কর্মকর্তা।
ওটিপি সংগ্রহ: কল মার্জ হওয়ার পর, ব্যাংক থেকে ওটিপি আসলে সেটি হ্যাকার শুনে ফেলতে পারে।
অর্থ লেনদেন: হ্যাকার তখন ওটিপি ব্যবহার করে দ্রুত আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেয়।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে। এবং আপনি টের পাওয়ার আগেই আপনার অ্যাকাউন্ট খালি হয়ে যেতে পারে।
প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকেই
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ইতিমধ্যে বহু মানুষ এই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনেকে তাদের সঞ্চয়ের পুরো টাকাই হারিয়েছেন। সাইবার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, হোয়াটসঅ্যাপ কল মার্জ ফিচার ব্যবহার করে প্রতারণা করার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ কারণে ভারতে সরকারিভাবে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যবহারকারীদের সচেতনতা না থাকলে এই ধরনের প্রতারণা ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রযুক্তির বিকাশ যেমন সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনি অপরাধীদের জন্যও খুলে দিয়েছে নতুন সুযোগ।
কীভাবে নিজেকে এই প্রতারণা থেকে রক্ষা করবেন?
এই প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সচেতনতা। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হলো, যা মেনে চললে আপনি নিরাপদ থাকতে পারেন:
অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কল মার্জ অনুরোধ এড়িয়ে চলুন।
আপনার পরিচিত কেউ কল মার্জ করতে চাইলে সরাসরি ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিন।
ব্যাংক কখনো ফোনে ওটিপি চায় না—এই বিষয়ে সচেতন থাকুন। কেউ ওটিপি চাইলে ধরে নিন সেটা প্রতারণা।
নিজেকে ব্যাংক কর্মী পরিচয় দিলে অফিসিয়াল নম্বর থেকে ফোন এসেছে কিনা যাচাই করুন।
যেকোনো সন্দেহজনক লেনদেন হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার ও সাইবার হেল্পলাইনে অভিযোগ জানান।
আপনার ফোনে অ্যান্টি ভাইরাস অ্যাপ ব্যবহার করুন এবং নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট রাখুন।
হোয়াটসঅ্যাপ-এর নিরাপত্তা সেটিংস যাচাই করে রাখুন। বিশেষ করে ‘Two-Step Verification’ চালু রাখুন।
সতর্কতা অবলম্বনই একমাত্র উপায়
প্রযুক্তির যুগে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফিচার আমাদের জীবনকে সহজ করছে। কিন্তু সেইসঙ্গে অপরাধীরাও তাদের কৌশল পাল্টে নিচ্ছে। তাই শুধু ফিচার ব্যবহার জানলেই চলবে না, সেই ফিচারটি কীভাবে অপব্যবহার করা যায় সেটাও জানতে হবে—নিজেকে রক্ষা করার জন্য।
আরও পড়ুনঃ চাষ ছাড়াই আলু উৎপাদনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন
সাইবার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হোয়াটসঅ্যাপের কল মার্জ আরও উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার। যেমন কল মার্জ করার সময় অডিও রেকর্ডিং বন্ধ রাখা কিংবা অপরিচিত কলারদের সঙ্গে মার্জ করার আগে একাধিক সতর্কবার্তা দেওয়া। তবে ততদিন পর্যন্ত, সাধারণ ব্যবহারকারীকেই সচেতন থাকতে হবে।
সাইবার অপরাধীরা দিন দিন আরও চতুর হয়ে উঠছে। তারা জানে, মানুষ প্রযুক্তিতে নির্ভরশীল হলেও অনেক সময় অতি সহজ বিশ্বাসে পড়ে যায়। এই সুযোগটাই তারা নিচ্ছে। তাই হোয়াটসঅ্যাপ, ব্যাংকিং বা অন্য কোনো অ্যাপ ব্যবহার করার সময় শুধু সুবিধার দিক না দেখে, তার ঝুঁকির দিকগুলোও জানতে হবে।
অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস না করা, ওটিপি গোপন রাখা, এবং সন্দেহজনক কিছু দেখলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াই হতে পারে এই প্রতারণা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ।
আপনার সচেতনতা—আপনার সম্পদের নিরাপত্তা।
সতর্ক থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।
এই প্রতিবেদনটি যদি আপনাকে সহায়ক মনে হয়, অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করুন—তারা হয়তো আপনার শেয়ার করা তথ্যের মাধ্যমে একটি বড় প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারে।