
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় আসছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৬ সাল থেকে এসএসসি (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) ও সমমান পরীক্ষার নম্বর বিভাজনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
এই নতুন পরিবর্তনের ফলে ৩টি বিষয় ব্যতীত বাকি প্রায় সব বিষয়ে ১০০ নম্বরের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আসবে এবং শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও সৃজনশীলতাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নতুন কাঠামোর সারসংক্ষেপ
২০২৬ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কার্যকর হবে এই নতুন নম্বর কাঠামো। বর্তমানে যারা নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত, তারাই প্রথমবারের মতো এই নতুন নিয়মে পরীক্ষা দেবে। এনসিটিবির এই সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
নতুন কাঠামো অনুযায়ী প্রতিটি বিষয়ের সৃজনশীল প্রশ্ন, সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, বর্ণনামূলক অংশ ও এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী প্রশ্ন) কীভাবে বিভাজিত থাকবে, তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গভীরভাবে বিষয়বস্তু আয়ত্ত করার প্রতি উৎসাহিত করা হবে।
বিষয়ভিত্তিক নম্বর বিভাজন
নিচের সারণিতে বিষয়ভিত্তিক নম্বর বিভাজন তুলে ধরা হলো:
১০০ নম্বরের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা যেসব বিষয়ে
বিষয়সমূহ |
---|
বাংলা (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) |
ইংরেজি (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) |
গণিত |
উচ্চতর গণিত |
বিজ্ঞান |
পদার্থবিজ্ঞান |
রসায়ন |
জীববিজ্ঞান |
বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় |
ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা |
ভূগোল ও পরিবেশ |
অর্থনীতি |
পৌরনীতি ও নাগরিকতা |
ব্যবসায় উদ্যোগ |
হিসাববিজ্ঞান |
ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং |
ইসলাম শিক্ষা |
হিন্দু ধর্ম শিক্ষা |
বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা |
খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা |
কৃষিশিক্ষা |
গার্হস্থ্যবিজ্ঞান |
চারু ও কারুকলা |
সংগীত |
আরবি |
সংস্কৃত |
পালি |
বেসিক ট্রেড |
৫০ নম্বরের পরীক্ষা যেসব বিষয়ে
বিষয় | পরীক্ষার পূর্ণমান |
---|---|
শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা | ৫০ |
ক্যারিয়ার শিক্ষা | ৫০ |
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) | ৫০ |
পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য কী?
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মতে, এই পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে—
- মুখস্থনির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে বিশ্লেষণ ও বাস্তবধর্মী শিক্ষা নিশ্চিত করা।
- শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
- পাঠ্যক্রমের সাথে মূল্যায়ন পদ্ধতির সঙ্গতি বজায় রাখা।
- আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে একীভূত করা।
শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। অনেক শিক্ষক মনে করছেন, “এনসিটিবির এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের আরও পরিপক্ব করে তুলবে। যদি আমরা শ্রেণিকক্ষে ঠিকভাবে এই কাঠামো বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে শিক্ষার মান অনেক গুণে উন্নীত হবে।”
তবে তারা এও বলছেন, এই কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মানসম্মত প্রশ্নব্যাংক এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি
যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তাদের এই নতুন কাঠামোর আওতায় ২০২৬ সালে প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষায় বসতে হবে। ফলে তাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
- পাঠ্যবই ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে।
- সৃজনশীল প্রশ্নের অনুশীলন বাড়াতে হবে।
- সংক্ষিপ্ত ও এমসিকিউ প্রশ্নের প্রতি সমান মনোযোগ দিতে হবে।
- পাঠ্যবিষয়ের বিশ্লেষণী দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
অভিভাবকদের ভূমিকা
শুধু শিক্ষার্থী নয়, অভিভাবকদেরও এই পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। তাদের সন্তানদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে সহায়তা করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন মানসিক চাপে না ফেলে ধাপে ধাপে গ্রহণযোগ্য করে তুললে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সেরা ১০ কলেজ: শিক্ষা, ঐতিহ্য ও সমাজ গঠনের মিশন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি
এই কাঠামো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন থেকেই স্কুলগুলোকে:
- বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
- শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
- পরীক্ষার অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে।
শুধু পরীক্ষার কাঠামো নয়, বরং পাঠদানের কৌশলও নতুনভাবে সাজাতে হবে বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্য
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণধর্মী মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এনসিটিবির এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেই আন্তর্জাতিক ধারার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পরিবর্তনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
নতুন কাঠামো চালু হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন:
- প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষক সংকট ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি।
- শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথ্য ঘাটতি ও বিভ্রান্তি।
- পাঠ্যবই এবং পাঠপ্রণালির সঙ্গে নম্বর বিভাজনের সামঞ্জস্য।
তবে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এসব সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নেওয়া এই নতুন নম্বর বিভাজন পদ্ধতি এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার মূল্যায়ন কাঠামোতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে দিয়ে বিশ্লেষণী, বাস্তব ও সৃজনশীল শিক্ষাকে উৎসাহিত করাই এই কাঠামোর মূল লক্ষ্য।
শিক্ষার্থীদের যেমন এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সব পক্ষ সঠিক প্রস্তুতি নিলে, এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলেই শিক্ষাবিদদের বিশ্বাস।
আপনার জানা প্রয়োজন:
এই কাঠামো নিয়ে আরও বিস্তারিত নির্দেশনা এবং নমুনা প্রশ্নপত্র অচিরেই এনসিটিবির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
উৎস: এনসিটিবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত