
বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা থাকবে না। তবে, বেসরকারি স্কুল ও কলেজে এন্ট্রি লেভেলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর নারী কোটার বিধান প্রযোজ্য হবে না। বৃহস্পতিবার (২২ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এছাড়া, ‘সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)’ ও ‘শরীরচর্চা শিক্ষক’ পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য শর্ত অপরিবর্তিত থাকবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল ও কলেজে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী কোটা থাকবে না। একই সঙ্গে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী ‘সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)’ এবং ‘শরীরচর্চা শিক্ষক’ পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য শর্ত অপরিবর্তিত থাকবে। তবে, এই প্রজ্ঞাপনটি গত ১৫ মে থেকেই অবিলম্বে কার্যকর হবে।
পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসনিক বিভাগ, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে, এ বিষয়ে এনটিআরসিএ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মতামত চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তারপর মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নির্দেশনার আলোকে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগেও সরকারি চাকরির মতো ৭ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের পক্ষে মত দেওয়া হবে।
বর্তমানে যে ৭ শতাংশ কোটা বহাল রয়েছে, তার মধ্যে ৫ শতাংশ নির্ধারিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য, ১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এবং ১ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
নারী কোটা বাতিলের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
নতুন এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এন্ট্রি লেভেলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে আগের মতো আর নারী কোটা সংরক্ষণের বিধান থাকছে না। তবে, “সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষা)” ও “শরীরচর্চা শিক্ষক” পদের ক্ষেত্রে আগের নীতিমালাই বহাল থাকবে। অর্থাৎ, এই দুটি পদের জন্য বিদ্যমান শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অন্যান্য শর্ত অপরিবর্তিত থাকবে।
প্রজ্ঞাপনের মূল নির্দেশনা
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নারী কোটার বিলুপ্তির পাশাপাশি এনটিআরসিএ, শিক্ষা বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান নির্দেশনার আলোকে নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিকে আরও নিরপেক্ষ ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
চিঠি চালাচালির পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয় মন্ত্রণালয়
উল্লেখ্য, এর আগে এনটিআরসিএ (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে নারী কোটার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি মতামত পাঠানো হয়েছিল। এরপর মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় আসে। সেই বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত হয়—বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগেও সরকারি চাকরির মতো ৭ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা বজায় থাকবে। তবে নারী কোটাকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।
আরও পড়ুনঃ সেরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ২০২৫ – ভর্তির তথ্য, ফি ও অবস্থান
বর্তমান কোটা কাঠামো কী বলছে?
বর্তমানে সরকারি চাকরির নিয়োগে যে ৭ শতাংশ কোটা কার্যকর রয়েছে, সেটি নিচের মতোভাবে বণ্টিত:
কোটা ক্যাটাগরি | প্রতিশত |
---|---|
মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারী পরিবার | ৫% |
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী | ১% |
শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ | ১% |
এই তিনটি শ্রেণির জন্য বরাদ্দ রাখা হলেও নারী কোটার কোনো উল্লেখ সেখানে নেই। অর্থাৎ, নারী প্রার্থীরা এখন থেকে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অন্যান্য প্রার্থীদের সঙ্গে সমান শর্তে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেবেন।
নারী কোটার বিলুপ্তি: সুফল না কুফল?
নারী কোটার বিলুপ্তি নিয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একটি ধাক্কা মনে করছেন, আবার কেউ বলছেন—প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমতা আনতে এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী।
বিশেষ করে শহরাঞ্চলে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও, অনেক অঞ্চলে এখনো তাদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। ফলে নারী কোটা তুলে দিলে পিছিয়ে পড়া নারীরা আরও বৈষম্যের মুখে পড়তে পারেন বলে মন্তব্য করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি
শিক্ষানীতিবিদ অধ্যাপক নাজমা রহমান বলেন,
“এই সিদ্ধান্তটি মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে নজর দিতে হবে যেন পিছিয়ে পড়া নারীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন।”
অন্যদিকে শিক্ষা পর্যবেক্ষক মহসিন আলী মত প্রকাশ করে বলেন,
“দেশে এখনও অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী আছে যারা পরিবার, সমাজ এবং আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। নারী কোটার মাধ্যমে তাদের একটি সহায়তা দেওয়া হতো, সেটি বন্ধ হওয়া দুঃখজনক।”
সম্ভাব্য প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর নারী শিক্ষকদের সংখ্যা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে প্রভাবিত হয়, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একথা নিশ্চিত যে, এখন থেকে সবাইকে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করতে হবে, এবং নারী প্রার্থীদের আরও বেশি প্রস্তুত হয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি ভবিষ্যতে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতা-ভিত্তিক করতে চায়, তাহলে শুধু কোটা নয়, বরং প্রান্তিক নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, স্কলারশিপ ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণে উৎসাহমূলক নীতিমালা চালু করাও জরুরি হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য মোড়। নারী কোটার অবসান বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে একদিকে যেমন সমান সুযোগের বার্তা বহন করছে, অন্যদিকে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারকে এখন অন্য পথ খুঁজে নিতে হবে। সময়মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা ও কার্যকর নীতিমালা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত নারী শিক্ষকদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই নতুন প্রজ্ঞাপন এখন থেকে শিক্ষক নিয়োগে একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেবে—যেখানে মেধা, দক্ষতা এবং প্রতিযোগিতাই হবে নিয়োগের একমাত্র ভিত্তি।