শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরল নব্বই দশকের ঐতিহ্যবাহী শপথ, যুক্ত হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার

“বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী শপথ পাঠ করছে শিক্ষার্থীরা”
২০২৫ সালে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু হলো নতুন দুর্নীতিবিরোধী শপথ

নৈতিকতা জাগাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন উদ্যোগ

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আবারও যুক্ত হলো নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও দুর্নীতিবিরোধী চেতনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদ্য জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন প্রাত্যহিক সমাবেশে পঠিতব্য শপথ বাক্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। নব্বই দশক ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী শপথ বাক্যটি ফিরিয়ে আনা হলেও এবার তাতে বিশেষভাবে সংযোজন করা হয়েছে ‘অন্যায় ও দুর্নীতি করব না, অন্যায় ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিব না’—এই সাহসী অঙ্গীকার।

এই পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা। নতুন এই শপথের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দুর্নীতি ও অন্যায় থেকে নিজেকে দূরে রাখার শিক্ষা পাবে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

সরকারি আদেশ ও প্রজ্ঞাপন

বুধবার, ২১ মে ২০২৫ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এই প্রজ্ঞাপন জনস্বার্থে জারি করা হয়েছে। এতে দেশের সব সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নতুন শপথ চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট দপ্তর যাদের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে:

দপ্তরের নামদায়িত্ব
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC)উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণ
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (DSHE)স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বাস্তবায়ন
জেলা শিক্ষা অফিসমাঠ পর্যায়ে তদারকি
সকল সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধানবাস্তবায়ন ও মনিটরিং

নতুন শপথ বাক্য: ভবিষ্যৎ নির্মাণে সচেতন প্রতিজ্ঞা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী শপথ বাক্যটি হলো:

“আমি শপথ করিতেছি, মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখিব। দেশের প্রতি অনুগত থাকিব। দেশের একতা ও সংহতি বজায় রাখিবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকিব। অন্যায় ও দুর্নীতি করিব না এবং অন্যায় ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিব না। হে মহান আল্লাহ/মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে শক্তি দিন, আমি যেন বাংলাদেশের সেবা করিতে পারি এবং বাংলাদেশকে একটি আদর্শ, বৈষম্যহীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারি। আ-মি-ন।”

এই শপথে মূলত সমাজসেবার মানসিকতা, দেশপ্রেম, ঐক্য এবং সর্বোপরি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ এসএসসি পরীক্ষার নম্বর বিভাজনে বড় পরিবর্তন: ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হবে নতুন কাঠামো

পূর্ববর্তী শপথ বাক্য: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের একটি নতুন শপথ বাক্য পাঠ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যার মূল বিষয়বস্তু ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। সেই শপথে বলা হয়েছিল:

“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। আমি দৃপ্তকণ্ঠে শপথ করছি যে, শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তুলব। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে শক্তি দিন।”

এই শপথ ইতিহাস ও আদর্শকে কেন্দ্র করে গঠিত হলেও সদ্য প্রবর্তিত শপথে যুক্ত হয়েছে আধুনিক সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন।

বিশ্লেষণ: সময়ের দাবি ও নতুন চেতনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি একটি প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা চিরাচরিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

ড. রেজাউল করিম, শিক্ষা বিশ্লেষক বলেন—
“শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যপুস্তক দিয়ে দেশ গড়ার শিক্ষা দেওয়া যথেষ্ট নয়। তাদের নৈতিক চেতনা, সততা ও দায়িত্ববোধের বিকাশ প্রয়োজন। এই নতুন শপথ সেই দিকেই বড় পদক্ষেপ।”

উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য ফলাফল

নতুন শপথ চালুর মাধ্যমে যেসব উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে:

লক্ষ্যব্যাখ্যা
দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব সৃষ্টিছোটবেলা থেকেই ‘না’ বলার অভ্যাস গড়ে উঠবে
দেশপ্রেম ও সমাজসেবার চেতনানাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা
মানবিক মূল্যবোধ জাগরণঐক্য, সংহতি ও সহনশীলতার শিক্ষা
নৈতিক নেতৃত্ব তৈরিভবিষ্যতের নেতা গড়ার ভিত্তি
শিক্ষা ব্যবস্থার মানবিক দিককে জোরদারকেবল পঠন-পাঠনে সীমাবদ্ধ না রেখে নৈতিক উন্নয়ন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিক্রিয়া: স্বাগত ও উদ্যোগ

ঢাকার একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, “এই নতুন শপথ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করবে। আমরা ইতোমধ্যেই প্রাত্যহিক সমাবেশে এটি চালু করেছি। শিক্ষার্থীরা খুব আগ্রহ নিয়েই শপথ পাঠ করছে।”

একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বলেছে, “পুরোনো শপথটি অনেক কিছু শেখাত, কিন্তু এখনকারটাতে যেটা যুক্ত হয়েছে—দুর্নীতিবিরোধী অংশ, সেটা আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে।”

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা

বিশ্বের অনেক দেশেই শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও সততা শেখাতে বিভিন্ন ধরনের শপথ বাক্য চালু রয়েছে। বাংলাদেশ এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সময়োপযোগী ও সমাজবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “শিশুদের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মনোভাব তৈরি করতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক কাঠামোর সমন্বিত ভূমিকা প্রয়োজন।” বাংলাদেশ সরকার এ দিকটি গুরুত্ব সহকারে দেখছে, তার প্রমাণ এই নতুন শপথ।

আদর্শ নাগরিক গড়ার পথে নতুন অধ্যায়

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও সততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই নতুন শপথ কেবল একটি বাক্য নয়—এটি একটি চেতনা, একটি অনুপ্রেরণা, এবং একটি প্রতিশ্রুতি। এ উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ, দায়িত্ববান এবং আত্মপ্রত্যয়ী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

এটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্য এক আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। নতুন প্রজন্মের হাতে গড়া হবে দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, উন্নত ও আদর্শ বাংলাদেশ।

আপনার মতামত দিন: আপনি কি মনে করেন, এই নতুন শপথ বাক্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাস্তব পরিবর্তন আনবে? মন্তব্যে জানান।
শেয়ার করুন: এই প্রতিবেদনটি বন্ধু ও পরিবারের সাথে শেয়ার করে তাদেরও জানিয়ে দিন দেশের শিক্ষাখাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের খবর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *