
দেশের কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। বিশেষ করে, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ সব কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির নিয়মে আসছে বড় রদবদল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকেই নতুন নিয়ম কার্যকর হবে। এই নিয়ম অনুযায়ী, ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের একটি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। ফলে, আগ্রহী ও যোগ্য শিক্ষার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় মান আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবর্তনের ঘোষণা শিক্ষা সচিবের মুখে
আজ সোমবার, ২৬ মে ২০২৫ তারিখে সচিবালয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম এই নতুন নিয়মের ঘোষণা দেন। সভায় তিনি বলেন,
“আমরা কারিগরি শিক্ষাকে আরও গুণগতভাবে উন্নত করতে চাই। শুধু এসএসসি পাস করলেই ভর্তি নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার। যে শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে আগ্রহী ও প্রস্তুত, তারাই যেন কারিগরি শিক্ষায় প্রবেশাধিকার পায় – এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”
বর্তমানে, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তির জন্য আলাদা কোনো ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় না। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারে এবং মেধাতালিকার ভিত্তিতে ভর্তি সম্পন্ন হয়। তবে, এই প্রক্রিয়ায় অনেক অনুৎসাহী বা অপ্রস্তুত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের আশাবাদ ব্যক্ত করেন সচিব।
কী থাকছে নতুন নিয়মে?
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তির জন্য ১০০ নম্বরের একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হবে। এর মধ্যে ৭০ নম্বর থাকবে এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী প্রশ্ন) ভিত্তিক একটি ভর্তি পরীক্ষায় এবং বাকি ৩০ নম্বর নির্ধারিত হবে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে।
আরও পড়ুনঃ বিসিএস সিলেবাস পরিবর্তন ২০২৫: মুক্তিযুদ্ধ বাদ, নতুন ইতিহাস
মূল্যায়ন কাঠামোঃ
উপাদান | নম্বর |
---|---|
ভর্তি পরীক্ষা (MCQ) | ৭০ |
একাডেমিক ফলাফল (এসএসসি ভিত্তিক) | ৩০ |
মোট | ১০০ |
ফলে, একটি স্বচ্ছ, মানসম্মত এবং প্রতিযোগিতামূলক ভর্তির ব্যবস্থা কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্য
সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম আরও বলেন, শুধুমাত্র আসন পূরণের লক্ষ্যে ভর্তি করালে কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। অনেক সময়, দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা কেবলমাত্র উচ্চমাধ্যমিকের বিকল্প হিসেবে এখানে ভর্তি হচ্ছে। ফলস্বরূপ, তাদের মধ্যে আগ্রহের অভাব থাকে এবং তারা কোর্সের মাঝপথে ঝরে পড়ে।
তিনি বলেন,
“আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, পলিটেকনিকে এমন শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যারা প্রকৃত অর্থেই টেকনিক্যাল শিক্ষায় আগ্রহী এবং পেশাগতভাবে দক্ষ হয়ে উঠতে চায়। এজন্য আমরা এই নতুন পদ্ধতি চালু করছি।”
কেন প্রয়োজন ভর্তি পরীক্ষা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিটেকনিক শিক্ষা মানে শুধু বই পড়ে পাশ করা নয়; এটি একটি দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা যেখানে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি হয়। এই কারণে, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও প্রস্তুতি যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র এসএসসি পাস করলেই সেই যোগ্যতা প্রমাণ হয় না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যক্ষ বলেন,
“অনেক সময় আমরা এমন শিক্ষার্থী পাই যাদের প্রকৃতপক্ষে টেকনিক্যাল বিষয়ে কোনো আগ্রহই নেই। কিন্তু তারা এখানে এসে ভর্তি হয়ে পরে কোর্সের মাঝপথেই ঝরে পড়ে। এতে করে আসন অপচয় হয়, কোর্সের মান কমে যায় এবং দেশের কারিগরি দক্ষতাও বাধাগ্রস্ত হয়। ভর্তির আগে একটি মানসম্পন্ন মূল্যায়ন হলে এই সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে।”
ভর্তির সময়সূচিতে পরিবর্তন আসতে পারে
নতুন ভর্তি পরীক্ষা চালু হওয়ার ফলে সম্ভবত, ভর্তি প্রক্রিয়ার সময়সূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। পূর্বে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি শুরু হতো, কিন্তু এখন ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন, প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশের জন্য অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হবে।
তবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এই প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য একটি পৃথক ভর্তি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটিই সার্বিক তদারকির দায়িত্ব পালন করবে।
বেসরকারি পলিটেকনিকে কি একই নিয়ম হবে?
এই বিষয়ে সচিব বলেন,
“প্রথম ধাপে কেবল সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতেই নতুন নিয়ম কার্যকর হবে। তবে ভবিষ্যতে একটি জাতীয় কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা রয়েছে।”
এই কারণে, সময়ের সাথে সাথে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষায়ও একই মান বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির দিক
ভর্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কারণ, অনেক শিক্ষার্থী ইতোমধ্যেই আবেদন প্রস্তুতি শুরু করে ফেলেছে, তারা এখন জানতে চাইছে – পরীক্ষার সিলেবাস কেমন হবে, কবে হবে পরীক্ষা, এবং কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।
একজন শিক্ষার্থী বলেন,
“ভর্তি পরীক্ষা যদি হয়, তাহলে আগে থেকেই আমাদের জানান উচিত ছিল। তাহলে আমরা সময়মতো প্রস্তুতি নিতে পারতাম। এখন চাইছি সরকার যেন মডেল প্রশ্নপত্র ও সিলেবাস প্রকাশ করে।”
পরীক্ষা কবে থেকে শুরু হবে?
যদিও এখনো নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হয়নি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে – ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরপরই এই নতুন ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা কার্যকর করা হতে পারে। তাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুব শিগগিরই একটি খসড়া নির্দেশিকা তৈরি করে তা সকল প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে।
প্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা
ভর্তি প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল করার পরিকল্পনা রয়েছে। সচিব জানান, অনলাইনে আবেদন, কেন্দ্র নির্বাচন, প্রবেশপত্র ডাউনলোড এবং ফলাফল প্রকাশ – সব কিছু হবে একটি কেন্দ্রীয় সফটওয়্যার ব্যবস্থার মাধ্যমে। ফলে, দুর্নীতি, অনিয়ম বা তথ্য গোপনের সুযোগ থাকবে না।
তিনি আরও বলেন,
“আমরা কারিগরি শিক্ষায় ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে আধুনিকতা আনতে চাই। প্রযুক্তিনির্ভর একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভর্তি ব্যবস্থা গড়তে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
কারিগরি শিক্ষা আজকের বাংলাদেশের শিল্প ও প্রযুক্তিখাতের বিকাশে অপরিহার্য একটি স্তম্ভ। তবে, এই শিক্ষাকে সফল করতে হলে প্রথমেই দরকার উপযুক্ত শিক্ষার্থী নির্বাচন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ভর্তি পরীক্ষাভিত্তিক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ। পরিশেষে, বলা যায়, এই নতুন নিয়ম কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে দেশ পাবে এমন একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, আত্মনির্ভরশীল এবং শিল্প-বান্ধব – যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে সহায়ক হবে।