
তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় প্রতিনিয়তই নতুন উদ্ভাবন আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ ও বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলছে। সেই ধারাবাহিকতায় গুগল সম্প্রতি তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর চ্যাটবট ‘জেমিনি’-তে যুক্ত করতে যাচ্ছে একটি বিপ্লবী ফিচার— ‘সার্কেল টু সার্চ’।
এই প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে এবং অল্প কিছু ব্যবহারকারী এর সুফল পেতে শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা সরাসরি স্মার্টফোনের পর্দায় প্রদর্শিত যেকোনো ছবি, লেখা, বা ভিডিও অংশ আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করলেই গুগল তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট সার্চ রেজাল্ট সরবরাহ করবে। আলাদা করে স্ক্রিনশট নেওয়া বা সার্চ উইন্ডো খুলে তথ্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন হবে না।
নতুন যুগের সার্চ অভিজ্ঞতা
গুগলের এই ফিচারটি মূলত ভিজ্যুয়াল এবং টেক্সচুয়াল কনটেন্ট বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি। ব্যবহারকারীরা অনলাইন শপিংয়ের সময় কোনো পোশাক বা জুতা দেখে তার নাম না জেনেও কেবল চিহ্নিত করে তার দাম, ডিজাইন বা কোথায় কিনতে পাওয়া যায় তা জেনে নিতে পারবেন।
শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও এটি অত্যন্ত কার্যকর। কোনো বইয়ের পৃষ্ঠার নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ বোঝা না গেলে সেটি চিহ্নিত করলেই জেমিনি তার ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারবে। সাংবাদিক, গবেষক এবং কনটেন্ট নির্মাতারাও বিভিন্ন রিপোর্ট, চিত্র বা ভিডিও বিশ্লেষণে এই ফিচার থেকে অনেক উপকার পাবেন।
প্রযুক্তির পেছনের গল্প
প্রযুক্তিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘অ্যান্ড্রয়েড অথরিটি’ জানায়, গুগল সম্প্রতি ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও প্রকাশ করে যেখানে জেমিনির নতুন ফিচার প্রদর্শিত হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, স্ক্রিনে একটি কনটেন্টকে সার্কেল করে সরাসরি জেমিনির কাছে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে ‘সার্কেল সার্চ (DF)’ নামের একটি অভ্যন্তরীণ ফিচার দেখা যায়। প্রযুক্তি জগতে ‘DF’ বলতে বোঝায় ‘Dogfood’, যা শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, এই ফিচারটি এখনো গুগলের কর্মীদের দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।
এই ফিচারটি চূড়ান্ত সংস্করণে রূপান্তরিত হয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে উন্মুক্ত হলে সেটি হবে তথ্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন।
ব্যবহারে সুবিধা
বর্তমানে তথ্য অনুসন্ধানে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট থেকে তথ্য বের করে আনা। ব্যবহারকারীদের স্ক্রিনশট নিয়ে তা গুগলে আপলোড করতে হয়, এরপর সঠিক শব্দ ব্যবহার করে সার্চ করতে হয়। কিন্তু সার্কেল টু সার্চ ফিচার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিচ্ছে।
যেকোনো কনটেন্টের উপর আঙুল দিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি করলেই সেই অংশটুকু জেমিনিতে চলে যাবে, এবং জেমিনি তাৎক্ষণিকভাবে এর ওপর ভিত্তি করে তথ্য বিশ্লেষণ করবে। এর ফলে ব্যবহারের সময় কমে যাবে এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা আরও সহজ ও গতিশীল হবে।
গুগলের কৌশলগত অবস্থান
বিশ্লেষকদের মতে, চ্যাটজিপিটি এবং মাইক্রোসফট কপাইলটের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকতে গুগল তার চ্যাটবট জেমিনিকে আরও শক্তিশালী করতে এই পদক্ষেপ নিচ্ছে।
গুগলের লক্ষ্য এখন শুধু সার্চ ইঞ্জিনে আধিপত্য বজায় রাখা নয়, বরং এআই সহায়ক সফটওয়্যারে নেতৃত্ব দেয়া। এই ফিচার জেমিনির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর প্রশ্ন বুঝে উত্তর দেওয়া ছাড়াও, স্ক্রিনের যেকোনো অংশ বিশ্লেষণ করে তথ্য দেয়ার ক্ষমতা বাড়াবে।
নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা
নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা একটি বড় প্রশ্ন। গুগল জানিয়েছে, ‘সার্কেল টু সার্চ’ ফিচারের মাধ্যমে স্ক্রিনের যেসব অংশ বিশ্লেষণ করা হবে, তা শুধুমাত্র ব্যবহারকারীর সম্মতিতেই সংরক্ষণ বা বিশ্লেষণ করা হবে। গোপনীয়তা রক্ষা করাই গুগলের অন্যতম অঙ্গীকার, এবং সেই লক্ষ্যেই এটি তৈরি করা হয়েছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
গুগল বর্তমানে এই ফিচারটি অ্যান্ড্রয়েড ১৪ চালিত ডিভাইস ও গুগল পিক্সেল ৮ সিরিজে পরীক্ষা করছে। ভবিষ্যতে এটি অন্যান্য ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন, বিশেষ করে স্যামসাং, ওয়ানপ্লাস এবং শাওমি ডিভাইসেও যুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে গুগল। এছাড়াও, জেমিনির ওয়েব সংস্করণ ও ডেস্কটপ ভার্সনেও এই ফিচার যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ চীনের ‘ডিপসিক’-এর আর-১ মডেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে
ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা
গুগলের কর্মীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ফিচার ব্যবহারে তথ্য খোঁজার গতি অন্তত ৪০% বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব কনটেন্টের বিষয়বস্তু জটিল বা নতুন, সেখানে এর কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্য। অনেক ব্যবহারকারী জানিয়েছেন, তারা এখন আগের তুলনায় কম সময়ে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে পারছেন।
সব দিক বিবেচনায়, গুগলের ‘সার্কেল টু সার্চ’ প্রযুক্তি কেবলমাত্র একটি নতুন ফিচার নয়, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারিক প্রয়োগের একটি সফল উদাহরণ। এটি ব্যবহারকারীদের তথ্য অনুসন্ধানে গতিশীলতা ও নির্ভুলতা এনে দেবে, যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস