হোয়াটসঅ্যাপে চ্যানেল খুলে আয় করার নতুন পথ: ঘরে বসেই ইনকামের দিগন্ত

হোয়াটসঅ্যাপে চ্যানেল খুলে আয় করার নতুন পথ
হোয়াটসঅ্যাপে চ্যানেল খুলে আয় করার নতুন পথ

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটসঅ্যাপ এখন আর শুধু বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম নয়, বরং হয়ে উঠেছে একটি বহুমাত্রিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবহারকারীদের চাহিদার সমন্বয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফিচার যোগ করছে হোয়াটসঅ্যাপ। এ ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপে ‘চ্যানেল’ নামের একটি বিশেষ ফিচার, যা ব্যবহারকারীদের জন্য খুলে দিয়েছে ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের এক নতুন দিগন্ত।

২০২৩ সালের শেষ দিকে মেটার মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপ ‘চ্যানেল’ ফিচারটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫০টি দেশে একযোগে উন্মুক্ত করে। এই চ্যানেল ফিচারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা কেবল সামাজিক যোগাযোগই করতে পারছেন না, বরং ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন ব্যবসা, কোচিং, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংসহ নানা উপায়ে আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন।

🔍 কী এই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল?

হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল মূলত একটি ‘ব্রডকাস্ট’-ভিত্তিক কমিউনিকেশন টুল, যার মাধ্যমে চ্যানেল মালিক তাদের সাবস্ক্রাইবারদের উদ্দেশ্যে বার্তা, ছবি, ভিডিও, ফাইল ও লিঙ্ক পাঠাতে পারেন। সাধারণ ব্যবহারকারীদের বার্তা পাঠানোর সুযোগ না থাকলেও তারা কন্টেন্টে রিয়্যাক্ট করতে পারেন এবং শেয়ার করতে পারেন অন্যদের সঙ্গে।

এই ফিচারটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা তাদের মতামত, পণ্য বা সেবা বড় পরিসরে উপস্থাপন করতে পারেন, ঠিক যেমনটা করা হয় ইউটিউব বা টেলিগ্রামের চ্যানেলের মাধ্যমে। তবে হোয়াটসঅ্যাপের নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের পার্সোনালাইজেশন এবং ইউজার বেসের কারণে এটি আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে।

💼 চ্যানেল ব্যবহার করে কিভাবে ইনকাম করা যায়?

চ্যানেল খোলার পর কেবল বার্তা পাঠিয়েই নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য উপায় তুলে ধরা হলো:

১. 🎨 ফ্রিল্যান্সিং পরিষেবা প্রদর্শন

বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং একটি জনপ্রিয় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকেই লেখালেখি, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো স্কিল নিয়ে কাজ করছেন। হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা সহজেই নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন এবং ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেন।

চ্যানেলে নিজের কাজের নমুনা, পোর্টফোলিও, ক্লায়েন্ট রিভিউ, সার্ভিস চার্ট ইত্যাদি প্রকাশ করে সাবস্ক্রাইবারদের আকৃষ্ট করা যায়। এর মাধ্যমে একজন ফ্রিল্যান্সার নতুন প্রজেক্ট পেতে পারেন এবং নিয়মিত আয় করতে পারেন।

২. 🛍️ পণ্য ও ডিজিটাল প্রোডাক্ট বিক্রি

হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলকে ব্যবহার করে অনলাইন ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ও পরিষেবা প্রমোট করতে পারেন। কেউ যদি হ্যান্ডমেড প্রোডাক্ট, পোশাক, জুয়েলারি, বা কসমেটিকস নিয়ে ব্যবসা করেন, তাহলে এই চ্যানেল ব্যবহার করে তার প্রোডাক্টের ছবি, বিবরণ এবং মূল্য শেয়ার করতে পারেন।

এছাড়া যারা ডিজিটাল প্রোডাক্ট যেমন ই-বুক, ডিজিটাল আর্ট, অনলাইন কোর্স বা সফটওয়্যার বিক্রি করেন, তারাও এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিক্রি বাড়াতে পারেন। পণ্য সম্পর্কিত প্রশ্ন ও অর্ডার গ্রহণও সম্ভব হবে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের মাধ্যমে।

৩. 🔗 অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং

বর্তমান সময়ে অনলাইন ইনকামের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হলো অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং। হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ব্যবহার করে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের অ্যাফিলিয়েট লিংক শেয়ার করা যায়।

যেমন ধরুন, অ্যামাজন, দারাজ, আলিবাবা বা ওয়ালটনের মতো প্রতিষ্ঠান যদি আপনাকে একটি অ্যাফিলিয়েট লিংক দেয় এবং সেই লিংক থেকে কেউ কিছু কিনে, তাহলে আপনি সেই বিক্রয়ের উপর কমিশন পাবেন।

চ্যানেলে রেগুলার রিভিউ, টিপস, ডিসকাউন্ট অফার ইত্যাদি শেয়ার করলে সাবস্ক্রাইবারদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয় এবং লিংকের মাধ্যমে বিক্রয় বাড়ে।

৪. 🎓 ওয়ার্কশপ ও কোচিং

আপনি যদি রান্না, অঙ্কন, সংগীত, ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি, পার্সোনাল ফিনান্স কিংবা যে কোনো বিষয়ে দক্ষ হন, তাহলে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যানেল খুলে অনলাইন ওয়ার্কশপ পরিচালনা করতে পারেন।

চ্যানেলের মাধ্যমে কোর্সের সিলেবাস, সময়সূচি ও ফি জানিয়ে আগ্রহীদের রেজিস্ট্রেশন নিতে পারেন। এরপর ভিডিও কল বা গ্রুপ ভিডিও সেশনের মাধ্যমে সরাসরি পাঠদান করানো সম্ভব। এতে করে শিক্ষার্থী যেমন সুবিধা পান, তেমনি আয় করাও সহজ হয়।

৫. 🧾 ক্যাটালগ ব্যবহার করে অর্ডার নেওয়া

যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যেমন কেক, হস্তশিল্প, ঘরোয়া পণ্য, তাদের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল হতে পারে আদর্শ একটি প্ল্যাটফর্ম। চ্যানেলের মাধ্যমে প্রোডাক্টের ক্যাটালগ প্রকাশ করে সরাসরি অর্ডার নেওয়া যায়।

পেমেন্ট গেটওয়ে সংযুক্ত করে পেমেন্ট গ্রহণ করা যায়। চ্যাট সাপোর্ট থাকায় গ্রাহকদের সাথে রিয়েল টাইমে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। ফলে একটি কার্যকর বিজনেস মডেল দাঁড় করানো যায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেই।

📲 কিভাবে চ্যানেল খুলবেন?

হোয়াটসঅ্যাপে চ্যানেল খুলতে হলে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:

  1.  

সর্বশেষ সংস্করণের হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাপ ইনস্টল করুন।

  •  
  •  

হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করে ‘আপডেটস’ ট্যাবে যান।

  •  
  •  

‘চ্যানেল’ সেকশনে ‘+’ আইকনে ক্লিক করুন।

  •  
  •  

এরপর ‘ক্রিয়েট চ্যানেল’ অপশন সিলেক্ট করুন।

  •  
  •  

চ্যানেলের নাম, বিবরণ, ছবি দিন এবং সাবমিট করুন।

  1.  
  2.  

একবার চ্যানেল তৈরি হলে আপনি তা ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন এবং সাবস্ক্রাইবারদের জন্য কনটেন্ট প্রকাশ করতে পারবেন।

  1.  

🔐 গোপনীয়তা ও নিয়ন্ত্রণ

হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল চালু হলেও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত নম্বর গোপন থাকে। চ্যানেল মালিক ও অনুসারীরা একে অপরের নম্বর দেখতে পান না।

এছাড়া চ্যানেলের কনটেন্ট ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে এবং তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যাবে। কনটেন্টে কে রিয়্যাক্ট করেছে বা দেখেছে সেটি কেবল চ্যানেল মালিক দেখতে পারবেন। চ্যানেল মালিক চাইলে অন্য অ্যাডমিন নিয়োগ করতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ গুগলের জেমিনি চ্যাটবটে আসছে ‘সার্কেল টু সার্চ’ প্রযুক্তি

🌐 পেশাদারদের পরামর্শ

ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল বর্তমান সময়ে একটি বড় সম্ভাবনাময় প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে কাজ করে থাকলেও হোয়াটসঅ্যাপের গ্রাহকভিত্তি এতটাই বিশাল ও সক্রিয় যে এখানে কাজ করলে দ্রুত ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

তবে আয়ের জন্য কনটেন্টের মান, নিয়মিত আপডেট, ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আন্তরিক যোগাযোগ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখা জরুরি। চ্যানেল তৈরি করেই যদি কেউ বসে থাকেন, তাহলে ফল পাওয়া কঠিন হবে।

📈 ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে মেটা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলের সঙ্গে আরও নতুন মনেটাইজেশন ফিচার যুক্ত করতে পারে। যেমন, সাবস্ক্রিপশন বেসড কনটেন্ট, চ্যানেল বুস্ট অপশন, ইন-অ্যাপ বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। ফলে এ প্ল্যাটফর্মটি আরও বেশি উপার্জনের উৎস হয়ে উঠবে।

তবে সেই সঙ্গে আসবে প্রতিযোগিতাও। তাই এখনই যাঁরা চ্যানেল তৈরি করে মানসম্মত কনটেন্ট দিতে পারবেন, তারাই ভবিষ্যতে সফল হবেন।

তথ্যসূত্র: হোয়াটসঅ্যাপ অফিসিয়াল ব্লগ, মেটা নিউজরুম, বিজনেস ইনসাইডার, টাইমস টেক রিপোর্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *