
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রধান বাহিনী হিসেবে কাজ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এর প্রতিষ্ঠা ঘটে, এবং আজ এটি একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রশিক্ষিত বাহিনী হিসেবে বিশ্ব দরবারে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
সেনাবাহিনীর জন্ম ও ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সূচনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, তাদের মাধ্যমেই গঠিত হয় এই বাহিনী। শুরুতে এটি ‘মুক্তিবাহিনী’ নামে পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ১১টি সেক্টরের আওতায় পরিচালিত যুদ্ধ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গঠিত হয় একটি সংগঠিত ও সমন্বিত সামরিক কাঠামো।
মুজিবনগর সরকারের অধীন ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’-এর প্রথম সংগঠিত রূপ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর। এ কারণেই প্রতিবছর এই দিনটি ‘সেনাবাহিনী দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের প্রতিরক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম অর্জন করে চলেছে।
সাংগঠনিক কাঠামো ও কোর
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আছেন একজন ফোর-স্টার জেনারেল পদমর্যাদার সেনাপ্রধান। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কোর রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে বাহিনীটি বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে।
উল্লেখযোগ্য কোর ও ইউনিটগুলো হলো:
- ইনফ্যান্ট্রি কোর
- আর্মার্ড কোর
- আর্টিলারি কোর
- ইঞ্জিনিয়ার কোর
- সিগন্যাল কোর
- মেডিকেল কোর
- মিলিটারি পুলিশ
- ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (DGFI)
- প্যারা-কমান্ডো ব্রিগেড (সোয়ারা ইউনিট)
এছাড়া রয়েছে কিছু বিশেষায়িত ইউনিট যেমন কমান্ডো বাহিনী, অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিট, মিসাইল ইউনিট, যা আধুনিক যুগের সামরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তৈরি।
প্রশিক্ষণ ও সামরিক শিক্ষা
সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে সুশৃঙ্খল, পেশাদার এবং সর্বোচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান:
- বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (BMA): যেখান থেকে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের সামরিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
- ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (DSCSC): উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য পরিকল্পনা, কৌশল এবং পরিচালনার প্রশিক্ষণ।
- মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (MIST): সেনা সদস্যদের আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করে তোলে।
- আর্টিলারি, সিগন্যাল, মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ার স্কুল: বিভিন্ন কোরের সদস্যদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেয়।
সেনাবাহিনীর র্যাংকিং বা পদমর্যাদা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সুসংগঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী। এর প্রতিটি সদস্য একটি নির্দিষ্ট পদমর্যাদার আওতায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন। র্যাংকিং বা পদমর্যাদা (Military Rank) শুধু বাহ্যিক পরিচয় নয়, এটি একটি দায়িত্ব, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের প্রতীক। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখা, আদেশ মান্য করা এবং অপারেশন কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য র্যাংকিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পদমর্যাদাভিত্তিক এই কাঠামো গড়ে ওঠে তিনটি স্তরে:
- কর্মকর্তা (Commissioned Officers): যুদ্ধ পরিকল্পনা, ইউনিট পরিচালনা, প্রশিক্ষণ ও প্রশাসনিক কাজ তাদের মূল দায়িত্ব।
- জেনারেল (General)
- লেফটেন্যান্ট জেনারেল (Lieutenant General)
- মেজর জেনারেল (Major General)
- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (Brigadier General)
- কর্নেল (Colonel)
- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (Lieutenant Colonel)
- মেজর (Major)
- ক্যাপ্টেন (Captain)
- লেফটেন্যান্ট (Lieutenant)
- সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট (Second Lieutenant)
- জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (JCO): অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেন।
- অনারারি ক্যাপ্টেন (Honorary Captain)
- অনারারি লেফটেন্যান্ট (Honorary Lieutenant)
- মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার (Master Warrant Officer)
- সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার (Senior Warrant Officer)
- ওয়ারেন্ট অফিসার (Warrant Officer)
- অ্যানলিস্টেড / সোলজার (Other Ranks): সেনাবাহিনীর মূল চালিকা শক্তি।
- ব্যাটালিয়ন রেজিমেন্ট সার্জেন্ট মেজর (Battalion Regiment Sergeant Major)
- ব্যাটালিয়ন রেজিমেন্ট কোয়ার্টার মাস্টার সার্জেন্ট (Battalion Regiment Quarter Master Sergeant)
- কোম্পানি ব্যাটারি সার্জেন্ট মেজর (Company Battery Sergeant Major)
- কোম্পানি ব্যাটারি কোয়ার্টার মাস্টার সার্জেন্ট (Company Battery Quarter Master Sergeant)
- সার্জেন্ট (Sergeant)
- কর্পোরাল (Corporal)
- ল্যান্স কর্পোরাল (Lance Corporal)
- সৈনিক (Sainik)
আরও পড়ুনঃ টিসিবিতে নতুন নিয়োগ: ৬টি পদের বিপরীতে ২২ জন জনবল নেওয়া হবে, আবেদন চলবে ২ জুন পর্যন্ত
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বাহিনী। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন কঙ্গো, সুদান, আইভরি কোস্ট, লাইবেরিয়া, মালিতে তারা সফলভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু দেশের গর্বই নয়, বরং বৈশ্বিক শান্তির এক অবিচ্ছেদ্য অংশীদার।
আধুনিকায়ন ও ফোর্সেস গোল ২০৩০
বর্তমান সরকার সেনাবাহিনীকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে “ফোর্সেস গোল ২০৩০” বাস্তবায়ন করছে। এর আওতায় সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে:
- আধুনিক ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান
- হেলিকপ্টার ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার
- UAV/ড্রোন ও স্যাটেলাইট
- সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতা
- নিজস্ব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন
সেনাবাহিনী দিব
প্রতি বছর ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দিবস উদযাপন করা হয়। এই দিনটি স্মরণীয়, কারণ ১৯৭১ সালের এই দিনে ১১টি সেক্টরকে একত্র করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছিল।
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও আহ্বান জানাচ্ছে দেশের তরুণ প্রজন্মকে—যারা স্বপ্ন দেখে দেশের জন্য কিছু করার, যারা বিশ্বাস করে নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও আত্মত্যাগে গড়া এক মহান পেশায় নিজেদের উৎসর্গ করতে—তাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে ৮৮তম বিএমএ (বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি) দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্প্রতি এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, যেখানে দেশের প্রতিটি জেলা থেকে যোগ্য প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবে। এটি শুধুমাত্র একটি চাকরির বিজ্ঞপ্তি নয়, বরং একটি গৌরবময় ও সম্মানজনক জীবনধারায় প্রবেশের দ্বার খুলে দিচ্ছে।
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
কোর্স নাম | ৮৮তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্স |
পদের নাম | অফিসার ক্যাডেট |
আবেদনের শেষ সময় | ১৩ জুলাই ২০২৫ |
চাকরির ধরন | পূর্ণকালীন (ফুল টাইম) |
কাজের স্থান | সারাদেশ |
লিখিত পরীক্ষার তারিখ | ২৬ জুলাই ২০২৫ |
আবেদনের মাধ্যম | অনলাইন |
যোগ্যতা ও শর্তাবলী | |
🔹 শিক্ষাগত যোগ্যতা | |
এসএসসি এবং এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় ন্যূনতম জিপিএ ৫.০০ থাকতে হবে। |
ও লেভেল ও এ লেভেল পদ্ধতির প্রার্থীদের জন্যও সমপর্যায়ের ফলাফল থাকতে হবে (অন্তত ৫টি বিষয়ে গ্রেড A বা B)।
ভোকেশনাল বা মাদ্রাসা বোর্ড থেকে উত্তীর্ণরাও আবেদন করতে পারবেন নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে।
বয়সসীমা
১ জানুয়ারি ২০২৬ তারিখে প্রার্থীর বয়স সর্বোচ্চ ২১ বছর হতে হবে (আর্মি মেডিকেল কোরের জন্য ব্যতিক্রম হতে পারে)।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়স ২২ বছর।
শারীরিক যোগ্যতা
পুরুষদের জন্য: উচ্চতা কমপক্ষে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, ওজন ও বুকের মাপ আনুপাতিকভাবে নির্ধারিত হবে।
নারীদের জন্য: উচ্চতা কমপক্ষে ৫ ফুট ২ ইঞ্চি।
উভয়ের জন্য স্বাস্থ্যগতভাবে সম্পূর্ণ ফিট থাকা আবশ্যক।
প্রবেশ প্রক্রিয়া
৮৮তম বিএমএ কোর্সে নির্বাচিত হতে হলে প্রার্থীদের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে:
লিখিত পরীক্ষা: ২৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন থাকবে ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান।
ইন্টারভিউ ও আইএসএসবি (Inter Services Selection Board): প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণদের ডাক পড়বে চার দিনব্যাপী আইএসএসবি পরীক্ষায়।
চূড়ান্ত মেডিকেল টেস্ট: আইএসএসবিতে নির্বাচিতদের সামরিক হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে।
চূড়ান্ত নির্বাচন ও প্রশিক্ষণ: সফল প্রার্থীদের বিএমএ-তে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হবে।
নারী প্রার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। নারী অফিসাররা আজ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নারীরা পুরুষ প্রার্থীদের মতোই প্রতিযোগিতামূলকভাবে নির্বাচিত হন এবং একই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যান। নারীদের জন্য আলাদা আবাসন, প্রশিক্ষণ সুবিধা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে।
দেশপ্রেম, নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধ—যা সেনাবাহিনীর মূল ভিত্তি
সেনাবাহিনী শুধুমাত্র একটি চাকরি নয়, এটি একটি জীবনধারা। দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বের গুণাবলি, আত্মত্যাগের মনোভাব—এই গুণগুলো যারা নিজের মাঝে ধারণ করে, তারাই প্রকৃত অর্থে একজন সেনা অফিসার হওয়ার যোগ্য।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসাররা শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন—এবং সর্বোপরি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করছেন।
বিশেষ নির্দেশনা
প্রার্থীদের অবশ্যই সশরীরে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
কোনো প্রকার জাল তথ্য প্রদান করলে আবেদন বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবেদনপত্রে দেওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।
প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের মোবাইল নম্বরে এসএমএস-এর মাধ্যমে জানানো হবে।
যোগাযোগের জন্য
আরও বিস্তারিত জানতে বা কোনো প্রকার সহায়তা পেতে যোগাযোগ করা যেতে পারে নিচের মাধ্যমে:
ওয়েবসাইট: www.joinbangladesharmy.army.mil.bd
ফোন: ০১৭৬৯০১২৭০০ / ০১৭৬৯০১২৭০১
যদি আপনি মনে করেন, দেশের জন্য কিছু করার প্রত্যয় আপনার মধ্যে আছে—আপনার নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয় অন্যরা—আপনি শৃঙ্খলা ও সাহসের আদর্শে নিজেকে গড়তে চান—তবে আর দেরি নয়। ৮৮তম বিএমএ কোর্সের অফিসার ক্যাডেট হওয়ার এই সুযোগ আপনার জন্য।
এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শুধু একটি চাকরির নয়, বরং বাংলাদেশের গর্বিত সেনাবাহিনীর একজন সম্মানিত সদস্য হওয়ার প্রথম ধাপ। এগিয়ে আসুন, গড়ুন নিজের ক্যারিয়ার, আর দেশের সেবায় নিয়োজিত হয়ে জীবনকে দিন নতুন অর্থ।