ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ডবল জিপিএ-৫ পেয়েও ব্যর্থ ১ লাখের বেশি শিক্ষার্থী: প্রশ্ন শিক্ষার গুণগত মানে

ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ডবল জিপিএ
ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ডবল জিপিএ

দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ডবল জিপিএ-৫ (এসএসসি ও এইচএসসিতে সর্বোচ্চ ফল) পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেননি।

ঢাবি রেজিস্ট্রার দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ইউনিটে ভর্তি আবেদন করেছেন মোট ৩ লাখ ২ হাজার ৬০৬ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৪ জন। তবে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বিজ্ঞান ও কলা ইউনিটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডবল জিপিএ-৫ পাওয়া ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬১ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১৮ হাজার ৭৪৭ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। অর্থাৎ ফেল করেছেন প্রায় ১ লাখ ২১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।

ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কা

শুধু বিজ্ঞান ইউনিটেই পাসের হার মাত্র ৬ শতাংশ, আর কলা ও আইন ইউনিটে প্রায় ১০ শতাংশ। এর মানে দাঁড়ায়, শতকরা ৯০ ভাগের বেশি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী কোনো না কোনো ইউনিটে পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। যা অভিভাবক মহলে এক ধরনের আতঙ্ক ও হতাশা ছড়িয়েছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান নিয়ে। এত বিপুল সংখ্যক ‘এ’ প্লাসধারী শিক্ষার্থী কেন ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না—এই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

যা প্রাপ্য নয়, সেটাই দেওয়া হচ্ছে”—অভিযোগ শিক্ষাবিদের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, “পাবলিক পরীক্ষায় এত ভালো ফল করার পরও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ফেল করাটা গভীর গবেষণার বিষয়। আমার মতে, আমাদের দেশে এখন এমন এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্য নয়—তাও তারা পাচ্ছে।”

তিনি যোগ করেন, “সরকার চায়, যত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ‘এ প্লাস’ পাবে, সেটাই তাদের সাফল্য হিসেবে প্রচার করা যাবে। ফলে অনেক সময় পরীক্ষকদের ওপর নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার চাপ থাকে। যে শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে বি প্লাস পাওয়ার যোগ্য, তাকেও কখনো কখনো এ প্লাস দেওয়া হচ্ছে।”

ফলাফল বনাম বাস্তবতা

পরীক্ষার ফলাফলে আরও দেখা গেছে, বিজ্ঞান বিভাগে সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা—১ লাখ ১৩ হাজার ৭২২ জন। মানবিক বিভাগে এ সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৩৯ এবং বাণিজ্য বিভাগে ৮ হাজার ৫৩৩ জন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা যাচাইয়ের কাঠামোতে এসব জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর বড় অংশই টিকতে পারেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের অনেকে বলছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে মুখস্থ নির্ভরতা, নম্বর নীতির অনিয়ম এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থার দুর্বলতাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

প্রশ্ন উঠছে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি নিয়েই

একাধিক শিক্ষাবিদ জানিয়েছেন, জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত মান কমছে। তারা মনে করছেন, ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন না করে, দক্ষতা ও বিশ্লেষণমূলক চিন্তার চর্চাকে গুরুত্ব না দিলে আগামীতে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা

সমাধান কী হতে পারে?

এই পরিস্থিতির সমাধানে শিক্ষাবিদরা যা বলছেন:

  •  

মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার: পাবলিক পরীক্ষায় নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে।

  •  
  •  

বেসিক স্কিলস চর্চা: মুখস্থবিদ্যার চেয়ে বিশ্লেষণমূলক ও সৃজনশীল দক্ষতা বাড়াতে হবে।

  •  
  •  

ভর্তি পরীক্ষায় মানসম্মত প্রশ্ন: যা ছাত্রদের বাস্তব চেতনা যাচাই করতে পারে।

  •  
  •  

শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ জরুরি

আরও পড়ুনঃ বিমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বিভিন্ন পদে নিয়োগ, আবেদন চলবে এক মাস


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল শুধু একাডেমিক ব্যর্থতার চিত্র নয়, এটি পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভঙ্গুর বাস্তবতাকেই সামনে নিয়ে এসেছে। এই সংকট সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং শিক্ষার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *