
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে গত কয়েক দশকে। এক সময় যেখানে শুধুমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরই নির্ভর করে উচ্চশিক্ষা চালু ছিল, সেখানে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সমানতালে জাতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। সরকারের ১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, যার অনেকগুলো এখন আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়েও জায়গা করে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, গবেষণার সুযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা।
নিচে আমরা “AD Scientific Index 2025” অনুযায়ী দেশের শীর্ষ ১০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরছি, যেগুলো বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
১. নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (North South University – NSU)
বাংলাদেশের প্রথম এবং অন্যতম স্বীকৃত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এর সুবিশাল ক্যাম্পাস রয়েছে, যার আয়তন প্রায় সাত একর এবং মোট স্পেস এক লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট। এখানে রয়েছে তিনটি বেজমেন্টসহ ছয়টি সুসজ্জিত ভবন। ২০০৯ সালে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে NSU-তে চারটি অনুষদের অধীনে মোট ১০টি বিভাগে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। উচ্চমানের একাডেমিক কাঠামো, গবেষণা সুযোগ, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক এবং আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ক্যাম্পাসের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং-এ প্রথম এবং বৈশ্বিকভাবে ৩১৫তম স্থান অধিকার করেছে।
🔗 ওয়েবসাইট: https://www.northsouth.edu
২. ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (BRAC University)
বিশ্ববিখ্যাত এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার মহাখালীতে অস্থায়ী ক্যাম্পাস দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে মেরুল বাড্ডায় নির্মিত হয়েছে এক বিশাল আধুনিক স্থায়ী ক্যাম্পাস।
এই ভবনটির ফ্লোর স্পেস প্রায় ১,৫৭,৯৩৫ বর্গমিটার, যেখানে রয়েছে ৭০০ আসনের অডিটোরিয়াম, ১৮৫০ আসনের বহুমুখী হল, ল্যাব, ডিজাইন স্টুডিও, আইটি ডাটা সেন্টার, ই-লাইব্রেরি সহ নানা আধুনিক সুবিধা। বর্তমানে এখানে ৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা এবং শিক্ষার সুযোগের জন্য BRACU বর্তমানে দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২য় এবং বিশ্বে ৪৫৮তম অবস্থানে রয়েছে।
🔗 ওয়েবসাইট: https://www.bracu.ac.bd
৩. ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় (East West University – EWU)
১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে ঢাকার রামপুরার আফতাবনগরে নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত শিক্ষকবৃন্দ এবং গবেষণামূলক কার্যক্রমের জন্য EWU শিক্ষার্থীদের কাছে একটি বিশ্বস্ত নাম।
বর্তমানে এখানে ৫০০০ শিক্ষার্থী এবং ১৮৭ জনের বেশি শিক্ষক রয়েছেন। গবেষণার মান ও বৈজ্ঞানিক অবদান বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি “AD Scientific Index 2025” অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩য় এবং সারা বিশ্বে ৫৪৪ তম স্থান অর্জন করেছে।
🔗 ওয়েবসাইট: https://www.ewubd.edu
৪. আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (AUST)
ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। এটি একটি গবেষণাভিত্তিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যা ঢাকা আহসানিয়া মিশন দ্বারা পরিচালিত। প্রকৌশল, স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও ব্যবসা শিক্ষায় এটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বর্তমানে AUST বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৬ষ্ঠ এবং বিশ্বে ৭৫৮তম অবস্থানে রয়েছে। গবেষণার মান, একাডেমিক সুশৃঙ্খলতা এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে এটি শিক্ষার্থীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।
🔗 ওয়েবসাইট: https://www.aust.edu
৫. ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ (IUB)
১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থিত। এটি একটি আন্ডাররেটেড হলেও অত্যন্ত গুণগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে রয়েছে ৩০,০০০ বই এবং শতাধিক জার্নাল। এছাড়া রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার, টেলিকম ও ইলেকট্রনিক্স ল্যাব।
বর্তমানে প্রায় ৭০০০ শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করছে এবং এটি দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে ৭ম এবং আন্তর্জাতিকভাবে ৭৭২তম অবস্থানে রয়েছে।
🔗 ওয়েবসাইট: https://iub.ac.bd
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সেরা ১০টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট: আধুনিক কারিগরি শিক্ষার দীপ্ত আলো
৬. আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (AIUB)
১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭ সালে খিলক্ষেতে তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করে। এটি চারটি অনুষদের অধীনে ১৫টি বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করে।
আধুনিক স্থাপত্য ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার জন্য AIUB বর্তমানে দেশের ৯ম এবং বিশ্বের মধ্যে ৯৮৮তম স্থান অর্জন করেছে। এর ক্যাম্পাসটি দেখতে অনেকটা কাচের গ্লোব আকৃতির এবং ১৩ লাখ বর্গফুট স্পেস নিয়ে গঠিত।
🔗 ওয়েবসাইট: https://www.aiub.edu
৭. ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (DIU)
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে সাভারের বিরুলিয়ায় “ড্যাফোডিল স্মার্ট সিটি”-তে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে একটি। রয়েছে একাডেমিক ভবন, হোস্টেল, খেলাধুলার মাঠ, সুইমিং পুল, লাইব্রেরি, রেস্টুরেন্ট, জিম ও অন্যান্য আধুনিক সুবিধা।
বর্তমানে এখানে প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী এবং ২৪টি বিভাগের অধীনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও গবেষণার মানে এটি দ্রুত অগ্রসরমান একটি প্রতিষ্ঠান।
🔗 ওয়েবসাইট: https://daffodilvarsity.edu.bd
৮. ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (UAP)
১৯৯৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত UAP বর্তমানে ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত। এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়টির একমাত্র ক্যাম্পাস। যাতায়াতে সুবিধা ও শিক্ষার মানের কারণে এটি রাজধানীভিত্তিক শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে স্থাপত্য, ফার্মেসি, আইন, প্রকৌশল ও ইংরেজি সহ আটটি বিভাগ। ২০২১ সালে স্পেনভিত্তিক হিমাগু ইনস্টিটিউশন র্যাংকিং অনুযায়ী এটি দেশের পঞ্চম সেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
🔗 ওয়েবসাইট: https://www.uap-bd.edu
৯. ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (IUBAT)
১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি ১৯৯২ সালের আইন অনুযায়ী স্বীকৃতি পায়। উচ্চশিক্ষায় কৃষি, ব্যবসা, প্রকৌশল ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অবদান রাখায় এটি এখন দেশের অন্যতম গুরুত্ববহ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৫ সালের AD Scientific Index অনুযায়ী এটি বাংলাদেশে ৪র্থ এবং বিশ্বে ৬৮৯তম অবস্থানে রয়েছে।
১০. বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (BAUET)
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত এবং প্রযুক্তি শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে পরিচালিত হয়। ২০১৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি দ্রুতই নিজের অবস্থান দৃঢ় করে নেয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০ম এবং বিশ্বে ১০২৭তম স্থান অর্জন করেছে।
শীর্ষ ১০ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা (AD Scientific Index 2025 অনুযায়ী)
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম | বাংলাদেশে অবস্থান | বিশ্বে অবস্থান |
---|---|---|
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (NSU) | ১ম | ৩১৫ তম |
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি (BRACU) | ২য় | ৪৫৮ তম |
ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি (EWU) | ৩য় | ৫৪৪ তম |
IUBAT | ৪র্থ | ৬৮৯ তম |
BUHS | ৫ম | ৭২২ তম |
আহ্ছানউল্লা (AUST) | ৬ষ্ঠ | ৭৫৮ তম |
IUB | ৭ম | ৭৭২ তম |
UODA | ৮ম | ৯৬৩ তম |
AIUB | ৯ম | ৯৮৮ তম |
BAUET | ১০ম | ১০২৭ তম |
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিঃসন্দেহে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তারা শুধু শহরাঞ্চলে নয়, গ্রামাঞ্চলেও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গঠনে, গবেষণা সম্প্রসারণে এবং বিশ্বমানে শিক্ষা প্রদানে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সঠিক দিকনির্দেশনা ও মানসম্পন্ন নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম স্তম্ভ।