বিসিএস সিলেবাস পরিবর্তন ২০২৫: মুক্তিযুদ্ধ বাদ, নতুন ইতিহাস

বিসিএস সিলেবাস পরিবর্তন ২০২৫ সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনা ও বিতর্ক
বিসিএস সিলেবাস পরিবর্তন ২০২৫: বাদ পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ, যুক্ত হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাসে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রাখা মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৭ মার্চের ভাষণ—এই ঐতিহাসিক বিষয়গুলো এবার ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের সিলেবাসে জায়গা পায়নি। এই অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। পিএসসির পক্ষ থেকে যদিও বিষয়টিকে “বিতর্ক এড়াতে কৌশলগত সিদ্ধান্ত” বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের একাংশ একে বাংলাদেশি চেতনাকে ক্ষুণ্ন করার প্রয়াস হিসেবে দেখছেন।

নতুন সিলেবাসে কী কী পরিবর্তন আনা হয়েছে?

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) গত ২২ মে, বুধবার ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের সিলেবাস প্রকাশ করে। নতুন এই সিলেবাসে “বাংলাদেশ বিষয়াবলি” অংশে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেখানে আগে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতো—

“বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস: ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৬, গণ-অভ্যুত্থান ১৯৬৮–৬৯, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, আন্তর্জাতিক সহায়তা, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ” ইত্যাদি।

সেই জায়গায় বর্তমানে বলা হয়েছে—

“বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস: আধুনিক যুগ (১৭৫৭ থেকে অদ্যাবধি)”

সিলেবাসে এভাবে একটি ব্যাপক সময়কে একত্রে আনা হলেও, এতে উল্লেখ নেই মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চের ভাষণ বা স্বাধীনতার ঘোষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির। শুধু তা-ই নয়, পরিবর্তিত পয়েন্টে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং সংস্কার প্রস্তাবনার উল্লেখ নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: ৪৭তম বনাম ৪৮তম বিসিএস

বিষয়৪৭তম বিসিএস সিলেবাস৪৮তম বিশেষ বিসিএস সিলেবাস
মুক্তিযুদ্ধবিস্তারিতভাবে বর্ণিতসরাসরি উল্লেখ নেই, পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত
বঙ্গবন্ধু ও ৭ মার্চের ভাষণআলাদাভাবে উল্লেখসুনির্দিষ্টভাবে অনুল্লেখিত
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানঅনুল্লেখিতনতুন করে অন্তর্ভুক্ত
রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজআগের মতোই রয়েছেঅপরিবর্তিত

পিএসসির নীরবতা ও অভ্যন্তরীণ ব্যাখ্যা

বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে পিএসসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম ফোন রিসিভ করেননি। তবে কমিশনের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান,

“বিতর্ক এড়িয়ে চলার জন্যই কিছু শব্দ প্রত্যক্ষভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। পরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত প্রশ্ন থাকবে, তবে কিছু স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে যাতে বিতর্ক না হয়।”

তিনি আরও জানান, ৪৮তম বিসিএসের এই সিলেবাসই ভবিষ্যতের সাধারণ বিসিএসেও প্রতিফলিত হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৫ নির্দেশনা: শিক্ষা বোর্ডের ৩৩ দফা

শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া: মুক্তিযুদ্ধ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা গ্রহণযোগ্য?

সিলেবাস থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি বাদ যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করছেন, এটি কেবল একটি শব্দ নয়, বরং জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সরাসরি সাক্ষাৎকারে ক্ষোভ ঝাড়ছেন।

বিসিএস সিলেবাস পরিবর্তন ২০২৫: শিক্ষার্থীদের মন্তব্য

নুসরাত জান্নাত তালবিয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়:

“মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন দেশের অধিকার পেয়েছি। অথচ সেই ইতিহাস সিলেবাসে উপেক্ষিত। ২০২৪ সালের আন্দোলন সিলেবাসে জায়গা পেলেও, মুক্তিযুদ্ধ পেল না—এটি গভীর উদ্বেগজনক।”

তাহমিনা আক্তার হ্যাপি, সাবেক শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ:

“মুক্তিযুদ্ধের কথা পরোক্ষভাবে থাকলেও, সিলেবাসে সরাসরি শব্দটি না থাকাটা বিতর্কের সৃষ্টি করছে। আমরা একটিকে বড় করতে গিয়ে, অন্যটিকে ছোট করতে পারি না। এটি শহীদদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করা।”

বিশ্লেষকদের মতামত

শিক্ষাবিদ ও ইতিহাস বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের মৌলিক ভিত্তি। এটি বাদ দিয়ে কোনো নাগরিকের কর্মজীবন বা রাষ্ট্রচিন্তা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তারা পিএসসিকে আহ্বান জানিয়েছেন পুনরায় পর্যালোচনা করে সিলেবাসে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করার।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন,

“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকতে পারে, কিন্তু এটি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ। একজন বিসিএস ক্যাডারের কাছে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও চেতনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অপরিহার্য।”

সাংবিধানিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ

সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী অনুযায়ী, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার ঘোষণার বিকৃতি বা অস্বীকার সংবিধানবিরোধী। সে আলোকে কোনো সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাস থেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসকে বাদ দেওয়া সাংবিধানিক প্রশ্নও উত্থাপন করছে।

ভবিষ্যৎ বিসিএস পরীক্ষার দিকনির্দেশনা

এই পরিবর্তন কি শুধুই বিশেষ বিসিএসের জন্য? না কি এটি সাধারণ বিসিএসেও অনুসরণ করা হবে? পিএসসির কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, সাধারণ বিসিএসেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হতে পারে।

এই ঘোষণায় অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে দূরে সরে যাবে। যা জাতীয় চেতনার দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে।

করণীয়: শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা ও সমাধানের পথ

শিক্ষার্থীরা চাইছেন—

  1. মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও ৭ মার্চের ভাষণকে সিলেবাসে পুনরায় যুক্ত করা হোক।
  2. ইতিহাসের সঙ্গে আপোস নয়—বরং আরও তথ্যভিত্তিক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
  3. সিলেবাস প্রণয়নে স্বাধীন ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদদের যুক্ত করার আহ্বান।

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ঘোষণার মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। বিসিএস পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষায় এগুলোর প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি শুধু বিতর্কই নয়, জাতির ভবিষ্যৎ পথচলার দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রেও প্রশ্নের সৃষ্টি করে। তাই বিষয়টি শুধু সিলেবাস পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *