
বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর না হওয়ায় দেশের ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
দীর্ঘ সময়েও নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস, অসন্তুষ্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়
২০০০ দশকের শুরুর দিকে অনুমোদনপ্রাপ্ত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ভাড়া করা ভবনে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ৭ বছরের মধ্যে এবং অতিরিক্ত ৫ বছর সময় নিয়ে সর্বোচ্চ ১২ বছরের মধ্যে তাদের নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ১৫-২০ বছর পার করেও এখনও ভাড়া করা ভবনে চলছে।
ইউজিসির সদস্য এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, “১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ ১২, কেউ ১৫, আবার কেউ ২০ বছর অতিক্রম করেছে। অথচ তারা এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়নি। বারবার সময় দিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি।”
আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছেন ইউজিসি
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার ভিত্তিতে ইউজিসি-এর মাসিক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপ চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান ড. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, “বিষয়টি এখন আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়ন হবে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত বোর্ডের অনুমোদনক্রমে।”
ইতিমধ্যে ইউজিসি তিন মাস আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছিল ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের অগ্রগতি নেই। তবে মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাঠানো সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী বাস্তবে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮টিতে।
আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারা ১২(১)-এ বলা হয়েছে—“যে বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করতে ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এই আইনের আওতায়, ইউজিসি বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন:
- নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত,
- নির্দিষ্ট কোর্সে ভর্তি নিষিদ্ধ,
- বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাতিল,
- সরকারি সহায়তা বন্ধ করা ইত্যাদি।
পূর্ববর্তী পদক্ষেপ ও বাস্তবতা
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ইউজিসি একটি চিঠির মাধ্যমে ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়কে সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছিল, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর নির্ধারিত সময় পার হলে ইউজিসি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে, দুটির অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ভর্তি নিষিদ্ধ করে এবং বাকি ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাড়তি সময় দেয়।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার
ঢাকায় অবস্থিত ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়:
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম | অবস্থান |
---|---|
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ | সাতমসজিদ রোড |
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ | সিদ্ধেশ্বরী |
দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি | রাজারবাগ |
দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ | মোহাম্মদপুর |
প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি | গুলশান |
প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি | বনানী |
আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ | শ্যামলী |
সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি | পান্থপথ |
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস | মিরপুর |
জেলা পর্যায়ে অবস্থিত ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়:
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম | জেলা |
---|---|
নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ | সিলেট |
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি | কিশোরগঞ্জ |
নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি | খুলনা |
ফেনী ইউনিভার্সিটি | ফেনী |
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি | চট্টগ্রাম |
চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি | চট্টগ্রাম |
ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি | কুমিল্লা |
সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির আংশিক ক্যাম্পাস | খিলগাঁও |
আরও একটি নাম প্রকাশযোগ্য নয় |
কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জরুরি পদক্ষেপ’ শুরু
ইউজিসির কড়া অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি ইতোমধ্যে তাদের অর্ধসমাপ্ত স্থায়ী ক্যাম্পাস উদ্বোধন করেছে। যদিও সেটি এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত নয়, তবু ক্যাম্পাসটি খিলগাঁও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়।
আরও পড়ুনঃ এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি নিয়ে তদন্তে নামছে শিক্ষা বোর্ড
ভর্তির আগে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি
বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৭টি। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও অবকাঠামো ভিন্ন। ফলে ভর্তি নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা তুলে ধরা হলো:
বিষয় | ব্যাখ্যা |
---|---|
বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স অনুমোদন আছে কি না | ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কোর্সে ভর্তি হওয়া উচিত নয়। |
ঢাকার বাইরে ক্যাম্পাস | কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকার বাইরে ক্যাম্পাস চালানোর অনুমতি নেই। |
স্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছে কি না | বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছে কি না তা যাচাই করুন। |
শিক্ষার মান ও অবকাঠামো | ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি ও শিক্ষক নিয়ে খোঁজ নিন। |
অ্যাডমিশনের ফি ও হিডেন চার্জ | খরচ ও অন্যান্য চার্জ সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। |
ডিপার্টমেন্টের চাহিদা ও সুযোগ | যে বিষয়ে পড়তে চান সেটির চাকরির বাজারে চাহিদা আছে কি না খতিয়ে দেখুন। |
ক্রেডিট সিস্টেম | ওপেন ক্রেডিট নাকি ক্লোজ ক্রেডিট, তা যাচাই করুন—বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য ওপেন ক্রেডিট উপযোগী। |
উচ্চশিক্ষায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা
বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে। ওই বছর প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়—নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (NSU)। সরকারের যুগোপযোগী আইন এবং উচ্চশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে NSU বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথমে একটি ভাড়াকৃত ভবনে শুরু হলেও বর্তমানে NSU ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় তাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে। এখানে রয়েছে আধুনিক গবেষণাগার, লাইব্রেরি, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ও বৈচিত্র্যময় কারিকুলাম।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
শিক্ষাবিদরা বলছেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এত বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি, তাদের বিরুদ্ধে সময়োচিত ও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা এবং সমাজে শিক্ষার প্রতি আস্থাও কমে যাবে।
একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষা বিশ্লেষক বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নির্ধারিত সময়েও স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করতে না পারে, তবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল হতে পারে না।”
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন
সরকারি পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে এক নতুন শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন সময় এসেছে শিক্ষার মানের সঙ্গে কোনো আপস না করে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের। সময়সীমা অতিক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখার জন্য অপরিহার্য।
এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো যাচ্ছে, যেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে তারা দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।